আমার প্রাণের চোখ খুলল প্রিয়ের সঙ্গে দেখা হল
‘কে তুমি?‘ পুছ করল সে
‘কেন, তুমি’– জবাব দিলাম আমি
– মনসুর আল হাল্লাজ (বলদিক ১৯৮৯: ৪৭)
মহাত্মা লালন ফকির নদীয়া কুষ্টিয়ার আপন সমাজে ‘সাঁইজি‘ নামে জারি আছেন। আমরাও এই নাম গ্রহণ করা উচিত জ্ঞান করি। সম্প্রতি মহাত্মা ফরহাদ মজহারও তাই করেছেন । (মজহার ২০০০)
শ্রী বসন্ত কুমার পাল বাংলা ১৩৩২ সালের শ্রাবণ সংখ্যা প্রবাসী পত্রিকায় ‘ফকির লালন শাহ‘ নামা প্রবন্ধ এবং ১৩৬১ সালে ‘মহাত্মা লালন ফকির‘ নামা বই প্রচার করেন। (চৌধুরী ১৯৭৪: ১৫৭-১৫৮) ইনি লেখেন: ‘আউল বাউল দরবেশ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সাধক সিদ্ধ হইলে তবে তাঁহাকে ‘সাঁই‘ আখ্যা দেওয়া হয় । লালন শাহ ‘সাঁইজী‘ আখ্যায় বিভূষিত হইয়াছিলেন।‘ (চৌধুরী ১৯৭৪: ১৬১)
পালজি বলেছেন: ‘লালন শাহ সাধনার উচ্চতম শীর্ষে আরোহণ করিয়াছিলেন।‘ তাঁরই উদ্ধার করা কথায়:
আউল বাউল দরবেশ সাঁই
সাঁইয়ের উপরে আর নাই
তবে একখান কথা আছে। সাঁইয়ের মানে আরো আছে। ‘সে‘ অর্থও সাঁই । সাঁইজির এক পদ এই রকম:
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের তুল্য কিছুই নাই
দেবদেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে ॥
(মজহার ২০০০: ৬৯)
অথবা, আর কথায়:
বলেছে সাঁই আল্লা নূরী
এই জেকেরের দরজা ভারি
সিরাজ সাঁই তায় কয় পুকারি
শোনরে লালন বে-লিল্লা ।
(মজহার ২০০০: ৯৩)
এখন আমরা গরিব। কোথায় দাঁড়াই? কোন ‘মানুষ‘ যখন ‘সাঁই‘, তখন সেই মানুষ ‘সাঁই মানুষ‘। তখন তাঁর ‘আমি‘ লোপ পায়। সাঁইজি লালনের পদে পদে আমরা এমন পদার্থ পাই । এই লেখায় আমরা এই রকম একজোড়া পদ ও পদার্থেরই সেবা করার বাসনা রাখি। ‘অপর‘ ও ‘পর‘ এই দুই ‘পদ‘ কোন কোন ‘পদার্থ‘ সৃষ্টি করে? সাঁই পদের সাথে এদের কোন নির্বন্ধ? ফরহাদ মজহার এই সম্বন্ধে যে, আলোচনার সূচনা করেছেন তা বাংলা ভাষায় নতুন। এই আলোচনা আগ বাড়িয়ে নেওয়ার দরকার আছে – এই আমাদের ধারণা। তাঁর মীমাংসায় আমরা উপকারও পাই। তবে কিছু সংশোধন করলে আমাদের চিন্তায় আরো মাত্রা যোগ হয়। এই মাত্রারই অপর নাম ‘সত্য‘।
আজ অল্পের মধ্যে তাই করতে চাই। সম্ভবত সত্যের বিকল্প নাই ।
১.
আসল কথা তোলার আগে দু-একটা নকল কথা পাড়ি। সাঁইজির পদ ও পদার্থ আলোচনার পদে পদে বাধা। এই বাধা তৈরি করেছেন বাংলা মুলুকের ভদ্রলোক শ্রেণীস্থ হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির পণ্ডিত লোকজন। এই শ্রেণীর লোকেরা মনে করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের ত্রাণকর্তা। এর মধ্যে কিছু সত্যও আছে । তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ফকিরের অর্থকর্তা মাত্র নহেন, অর্থহর্তাও বটেন – সেই কথা চাপা পড়ে গেছে। মুহম্মদ আবদুল হাই সাহেবকে ভদ্রশ্রেণীর উকিল গণ্য করা যায় । তিনি লেখেন:
…. রবীন্দ্রনাথ লালন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়েছিলেন এবং শ্রেষ্ঠ বাউল কবি হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বলেই তাঁর প্রতি বাঙালি কাব্যামোদী ও শিক্ষিত জনসাধারণের বিশেষভাবে দৃষ্টি পড়ে। তার ফলে দীর্ঘকাল ধরে আলোচিত হ‘তে হ‘তে তিনি তাঁর স মহিমায় প্রতিষ্ঠিত (হন)। নইলে কতকাল যে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেন, বলা যায় না। (চৌধুরী ১৯৭৪: ৮৯)
আবদুল হাইও – আর দশ ভদ্রলোকের মতন – সত্যি মনে করতেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা ও ভাব-সাধনা লালন ফকিরের সাথে তুলনীয়। ভদ্রলোকদের এই অহমিকা দূর করার কর্তব্য আমরা গ্রহণ করছি না। শুদ্ধ শুনে যাচ্ছি:
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, গীতালি ও গীতিমালা প্রভৃতি সঙ্গীতাখ্য কাব্যগুলোতে লালনের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে তার আধ্যাত্মিকতারও একটি সগোত্রতা লক্ষ্য করা যায়। এ সগোত্রতা অবশ্য প্রভাবজাত এতটা নয়, যতটা চিন্তা ও ভাব-সাধনার ঐক্যজাত। (চৌধুরী ১৯৭৪: ৮৯)
হাই সাহেবের এই বাক্য আর ব্যাকরণ-জ্ঞান দেখেও অনুমান করা চলে চিন্তা ও ভাব সম্পর্কে তাঁর ধারণা কত উঁচুতে উঠতে পারে। বাংলাদেশের ভদ্রলোকশ্রেণীর এই দীনতার পটভূমি বিশ্লেষণ না করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন খুবই সাধারণ কোন লেখক কি করে এত অসাধারণ বলে গণ্য হন বোঝা কঠিন I
ওদিকে ডক্টর মতিলাল দাশ আরো মজার মানুষ। তাঁর কাহিনীও শোনার মতনঃ
ভোলাই সা‘র নিকট হইতে গানের পুঁথি আদায় করিতে যথেষ্ট বেগ পাইতে হইয়াছিল। ভোলাই সা‘ বলিল, ‘দেখুন, রবি ঠাকুর আমার গুরুর গান খুব ভালবাসিতেন, আমাদের খাতা তিনি লইয়া গিয়াছেন, সে খাতা আর পাই নাই, কলিকাতা ও বোলপুরে চিঠি দিয়াও কোনও উত্তর পাই নাই।‘ এ কথার সত্যতা কতদূর কে জানে? কিন্তু ভোলাই কবিগুরুকে লালনের চেলা বলিয়া মনে করে এবং বলে যে কবিগুরু লালনের গানকে রূপান্তরিত করিয়াই জগৎ-জোড়া নাম কিনিয়াছেন। বৃদ্ধের এই মিথ্যা অহমিকা দূর করিয়া তাহাকে কষ্ট দিবার প্রয়োজন অনুভব করিলাম না। (চৌধুরী ১৯৭৪ : ৩৭)
দাশজির এই মহানুভবতায় আমরা মুগ্ধ। তিনি সত্যও বলতে পারেন সত্য সত্য । লালনের গান রূপান্তর করার প্রয়োজন রবিবাবুর ছিল না। তিনি প্রতিভাধর মানুষ। কিন্তু মতিলালবাবু হয়তো সন্দেহও করেন নাই মিথ্যা অহমিকাটা ভোলাই সা‘র না তাঁর নিজের । পাঠিকা খেয়াল করবেন, মতিলালবাবু কিন্তু বৃদ্ধ ভোলাইয়ের জন্য এক ক্রিয়ারূপ আর রবিবাবুর জন্য অন্য রূপ ব্যবহার করেছেন। এই আমলনামা অচেতনের লখনা (symptom)।
আমরাও মনে করি – তবে উল্টা কারণে – ফকির লালনের গানের পদ ও পদার্থ রবীন্দ্রনাথের উপযুক্ত হয় নাই। তাই আমরা ফরহাদ মজহারের মত সমর্থন করে বলতে চাই: লালন পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ বাদ দেওয়াই উত্তম। ফরহাদ লিখেছেন:
তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) রোমান্টিকতায় ফকির লালন শাহের ‘মানুষ‘ ধারণাটির তাৎপর্য অনুধাবন অসম্ভবই ছিল। সেই কারণে ‘মানুষ‘ শব্দটি বদলিয়ে ‘মানস‘ শব্দটি বসানোর গুরুতর ভাবগত বিপত্তি তাঁর বিচারে ধরা পড়ে নি। (মজহার ২০০০: ১৪)
ফকির লালন শাহ বাংলাদেশের দেশজ চিন্তার যেই ধারার শিখর পর্যন্ত পৌঁছেছেন সেই ধারার নাম ফরহাদ মজহার দিয়েছেন ‘বাংলার ভাবান্দোলন‘। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই ধারার সামান্যতম পরিচয়ও নাই। ফরহাদ বলেন:
বাংলার ভাবান্দোলনের ভাবের সমুদ্রের ধার দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোথাও হেঁটেছেন তার নজির রবীন্দ্র রচনার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। (মজহার ২০০০: ১৪)
বাংলাদেশে আমরা কোন জগতে বাস করে আসছি তার আরেকটা নমুনা দেই তো বোঝা যাবে, ফকির লালন শাহকে নিয়ে ভদ্রলোকরা কী করবেন ভেবে নিরুপায় কেন। এই বিপদের মধ্যেই আমি লিখি। দার্শনিক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন একদিন লালন শাহের তারিফ মনে করে এই ঘোষণা প্রচার করেন:
লালন শাহ দেহতত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের চেয়েও অধিক জ্ঞান রাখেন। এই উম্মি লোকের শব্দ-সম্ভারও দেখা যায় প্রচুর। অতএব এঁকে রীতিমত কৃষ্টিবান বলতে হয়। (চৌধুরী ১৯৭৪: 66 )
আলহামদুলিল্লাহ! পাছে আমরা ‘উম্মি‘ শব্দটা ভাল না বুঝি তাই কাজী হুজুর জানাচ্ছেন: লালন লোকটা ‘স্বয়ং শিক্ষিত‘ ছিলেন। বন্ধনীর মধ্যে জানিয়ে দিলেন এর মানে ‘অশিক্ষিত‘। (চৌধুরী ১৯৭৪: ৬৪) আমার কৌতূহল হয়, রবীন্দ্রনাথও যখন কপালগুণে গ্র্যাজুয়েট হন নাই, তো তাকেও কাজী সাহেব কি ‘স্বয়ং শিক্ষিত’ (বা অশিক্ষিত) জ্ঞান করতেন? হয়তো বৎসর বৎসর চলে যাবে, এই প্রশ্নেরও মিলবে না উত্তর।
২.
সাঁইজির গান বাঁধা হয়েছে শোনার খাতিরে, দেখার দাবিতে নয় । এখন লিখতে গিয়ে লোকে যার যার শিক্ষা ও বিশ্বাস মতন যা সত্য মনে করেন তাই লিখছেন। ফলে বেশ গোল পাকাচ্ছে । এই সমস্যার কথা ভুলে না গিয়েই সাঁইজির এই গানটির কথা বিবেচনা করছি। মতিলাল দাশের সংগ্রহ থেকে আমরা পড়বঃ
আপনারে আপনি রে মন না জান ঠিকানা
পরের অন্তর কেটে সমুদ্দর, কিসে যাবে জানা?
পর অর্থে পরম ঈশ্বর, আত্মারূপে করে বিহার
দ্বিদল বারামখানা, শতদল সহস্রদলে অনন্ত করুণা।
কেশের আড়েতে যৈছে, পৰ্বত লুকায়ে আছে
দরশন হল না।
এবার হেঁট নয়ন, যার নিকটে তার
সিদ্ধ হয় কামনা ।
সিরাজ সাঁই বলেরে লালন গুরুপদে ডুবে আপন
আত্মার ভেদ চেনে না।
আত্মা আর পরমাত্মা নিত্য ভেদ জেন না।
(চৌধুরী ১৯৭৪: ৩৮)
এই কালের অভিজ্ঞতায় জানা যায়, মনুষ্যশিশু ভাষা শেখার গোড়ার দিকে শুদ্ধ নাম শেখে। ‘আমি‘ বলার আগে নিজেকেও ‘সে‘ হিসাবেই চেনে। বাইরের জগতের ভিতরে শিশু ‘আবিষ্কার‘ করে নিজেকে। নিজেকেও সে একটা নাম ধরে ডাকে ।
যখন তার ‘আপন‘ বা ‘আমি‘ জ্ঞান হয় – তখন একই সাথে তার ‘পর‘ জ্ঞানও হয়। আপন না হলে পর হয় না, পর না হলে আপনও নাই। শিশুর প্রথম পর তার মা। মা কোন ব্যক্তির নাম হিসাবে নয়, যেই জায়গায় মা আছেন সেই জায়গার নাম হিসাবেও গণ্য । নগণ্য নয়। শিশু মা‘র কাছে সব আশা করে। এই আশালতা, এই নির্বন্ধ নাভি কাটার পরও অনেক দিন — জীবন্ময় – থাকে। যখন শিশু বড় হয়, কথা বলা শেখে, তখন মা ও শিশুর মাঝখানে ভাষা এসে হাজির হয়। এই ভাষাকে আমরা নামের দুনিয়া বলতে পারি। এই নামের দুনিয়া না হলে ‘মা‘ কে তা-ও চেনার উপায় থাকত না ।
এই নামের গুণেই শিশু বুঝতে শুরু করে, মা-ই শেষ কথা নয়, বাবাও আছে। ‘মা‘ ও ‘বাবা‘ এই দুটি পদের তাৎপর্যই আলাদা । যখন শিশুর জগতে কেউ নাই তখন শিশু ও মা একাকার, একদেহ। জন্মের পর শিশু দেখে মা কাঁদলেই ছুটে আসে, নড়েচড়ে, দুধ দেয় । এই লীলা চলে মা ও শিশু এই দুইয়ের আকারে। শিশুর কাছে মা-ই ‘পর’। কিন্তু যখন সে টের পায় মা সব দিতে পারে না, সব বাসনা মেটাতে পারে না – ভাষার দিকে বা তৃতীয় কিছুর দিকেও নজর দিতে হয়—তখন মায়ের খুঁত ধরা পড়ে। ভাষার মধ্যে বিধি আছে। একটা পদের পাশে আর পদটা বিধিমতন বসে । মা নিখুঁত নয়; তার ভিতরে শূন্য আছে । তখন মা হয়ে যায় ‘অপর’। আর যার মধ্যে শূন্য নাই সেই তৃতীয় হয়ে ওঠে পর। এই পরেরই অপর নাম ‘ভাষা’।
যেই পরের ভিতর খুঁত থাকতে পারে সেই পরকে ‘পর‘ বলা যায় না। সেই পরকে বাংলা ভাষার প্রতিভায় আমরা ‘অপর‘ বলি। পরের মর্যাদা হারিয়ে মা হয়ে ওঠেন শিশুর অপর । মহাত্মা ফরহাদ মজহার এই ভেদটা বুঝেছেন। তিনি বলেন:
“অপর” মানে পর নয়, এটা শুরুতেই বুঝতে হবে। অ-পর কথাটার আক্ষরিক দ্যোতনাও হচ্ছে, যে পর নয় । আবার আপনও নয়।
(মজহার ২০০০: ৩৫)
ফরহাদ মজহারের দান স্বীকার করার পর আমরা কবুল করছি: পর’ ও ‘অপর’ ভেদটি তিনিও শেষ পর্যন্ত ভেদ করেন নাই। আমরা সবিনয়ে সাঁইজির যে যে পদ উপরে নকল করলাম তারই উল্লেখ করে বলব: ‘পর অর্থে পরম ঈশ্বর‘। পরের চূড়ান্ত অর্থ ‘পরম‘ । ঈশ্বর বা আল্লাহ বা অন্য যেকোন পদে তার ভাব বিরাজ করে । সাঁইজির বোধে কোন ফাঁক ছিল না এই প্রশ্নে। তো ঈশ্বর পরম কেন? কারণ তার কোন খুঁত নাই, অপূর্ণতা নাই। দার্শনিক হেগেল এই খুঁতহীন, নিঃশূন্য ভাবকে পরম ভাব (Absolute Idea) নাম দিয়েছিলেন।
‘আপন’ তো পূর্ণ নয় । প্রথম ‘পর’ ওরফে ‘অপর’ও পূর্ণ নয়। কোন অসম্ভব পূর্ণ যখন নিজেকে দু-ফালা করে তখন এক ফালার নাম দাঁড়ায় ‘আপন‘, ‘নিজ‘, ‘আমি‘, ‘অহম’ ইত্যাদি। আর ফালার নাম দাঁড়ায় ‘পর’, ‘তুমি‘, ‘অন্য‘, ‘মানুষ‘, ‘লোক’ ইত্যাদি। অপূর্ণতার অপরাধে তার নাম দিতে হয় ‘অপর’।
এই স্থলে বাংলা ভাষার একটু তারিফ না করি তো বড় অন্যায় হয়। বাংলায় ভাগ্যিস ‘অপর’ ও ‘পর‘ দুইটি কথাই আছে। এয়ুরোপের কোন কোন ভাষায় – যেমন ইংরেজি বা ফরাসিতে – নাই। ইংরেজরা অপর অর্থে আদার (other) লিখবেন। ‘ও‘ অক্ষরটি ছোট পক্ষের দিতে হয়। মুখে বলে ‘ছোট পর‘ বা লিটল আদার। আর পর অর্থে আদার (Other) লিখবার সময় প্রথম হরফটি বড় হাতের দিতে হয়। বলতে হয় বিগ আদার বা ‘বড় পর’। ফরাসিতে পরের জন্য ওত্র (autre) পদ লেখা হয়। ওরাও বড় ‘আ’ ছোট ‘আ‘ লিখে এই ভেদ দেখান। জর্মান ভাষায় নির্দেশক বদলিয়ে কাজ সারার নিয়ম। ফ্রয়েড অপর বা ছোট পরের কাছাকাছি অর্থে der Andere (অপরলোক) লেখেন। আর পর—মানে বড় পর – অর্থে das Andere (অপরত্ব) লেখেন। (ইভানস ১৯৯৬: ১৩২)
তো আমাদের সামান্য বক্তব্য এই দাঁড়াল। সাঁইজির কথায় ‘একেতে হয় তিনটি আকার, অযোনী সহজ সংস্কার হে!‘ (চৌধুরী ১৯৭৪: ২৪) এই তিনটি আকারই ভাষায় ‘আমি’, ‘তুমি’ ও ‘সে‘ অথবা ‘আপন’, ‘অপর’ ও ‘পর’। চলতি ভাষায় আমি বলতে যা বোঝায় এখানে তার একটু অধিক কথা আছে। সাঁইজি প্রায়ই বলেন, ‘অধম লালন’ । এই অধম মানেও আমি-ই। একটা সম্পর্কের মধ্যে এই আমি বিরাজ করে; আলাদা থাকা তার ভাব নয় ।
৩.
বাংলা মুলুকের সাধক ফকিররা মাঝে মাঝে পরম ঈশ্বর বা আল্লাহকেও ‘তুমি’ ডাকেন। এখানে পর অপর হয়ে ফেরে। এর কী তাৎপর্য? প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পরম ঈশ্বর মানে পিতাও বটেন। সাঁইজিও গেয়েছেন:
শুনতে পাই পরম পিতা গো তুমি
অতি অবোধ বালক আমি
যদি ভজন ভুলে কুপথে ভ্রমি
তবে দাও না কেন সুপথ স্মরণ করে
পতিতকে তারিতে পতিত পাবন নাম
তাইতো তোমায় ডাকি গুণধাম
তুমি আমার বেলায় কেন হইলে বাম
আমি আর কতকাল ভাসব দুখের পাথারে ॥
(মজহার ২০০০: ৮৮)
বিধিই বাম হতে পারেন। আর মা যেমন একটি জায়গা –সম্পর্কের একটা কোণা বা বিন্দু–পিতা বা ঈশ্বরও তাই। কিন্তু বাড়তি এক সমস্যা দেখা দেয় এখানে । ঈশ্বর স্বয়ং বিধিরও অপর নাম । ঈশ্বর যখন একটা কোণা তখন কিন্তু তিনিও নিখুঁত নন, পর হিসাবে পূর্ণ নন। তিনি তখনই নিখুঁত ও পূর্ণ, যখন তিনিই স্বয়ং সম্পর্ক, শুদ্ধ তার একটা কোণা, প্রান্ত বা বিন্দু নন। এই পদের নামই পর– পরম পিতা বা ঈশ্বর, হেগেলের ‘পরম ভাব’।
ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁর যুগান্তকারী তাৎপর্য ঠিক এখানেই যে তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, এই পরম ভাব, পিতা বা পর আর কেউ নয়: স্বয়ং ভাষা। এবং পরম, পর বা ভাষার কাহিনীকেই তিনি সনাক্ত করেছেন মহাত্মা ফ্রয়েড-কথিত ‘অচেতন‘ বলে। সাঁইজির পর ও অপর বোঝার খাতিরে জাক লাকাঁর এই আবিষ্কার আমাদের অনেক সাহায্য করেছে।
মহাত্মা জাক লাকাঁর মত অনুসরণ করে বলছি: অপর ও পরের মধ্যে ভেদটি সামান্য ব্যাপার নয়। এই কথা সত্য যে আমরা নিত্যদিনের কায়কারবারে এই দুই পদ গুলিয়ে ফেলি । কিন্তু তার ফল ভাল নয়। পরের জগৎ শুদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেরই জগৎ নয় । এই জগৎ সাধারণভাবে নীতি ও ধর্মের জগৎ। বিধি ও ভাষার জগৎ । ফরহাদ মজহার লিখেছেন: ‘[ফকির লালন] কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, কোন সাধকই করেন না। সেই কারণে মোল্লা-পুরোহিতদের সঙ্গে সাধকদের লড়াই সবসময়ই অনিবার্য।‘ (মজহার ২০০০: ৩৬)
তবে ফরহাদ মজহার বা অন্য কোন দার্শনিকও আশা করি দাবি করবেন না যে সাধকরা ভাষায় বিশ্বাস করতেন না। সাধকদের যে বিশিষ্ট ভাষা, তাও সম্ভব হবে না যদি আমরা সামান্য ভাষার দাবি গ্রাহ্য না করি। আমি নীতি বা বিধি বলতে ভাষার সমান কোন বড় পদার্থ নির্দেশ করছি। যেই সকল চিন্তাবিদকে ফরহাদ মজহার ‘আধুনিক‘ নামে ডাকেন, সেই মহাশয়রাও বলেন: ‘নীতি ও ধর্ম মানুষের তৈরি।‘ দাবিটা এক অর্থে ঠিক হলেও অন্য অর্থে বেঠিকই।
এই নীতি বা সেই নীতি, এই ধর্ম বা সেই ধর্ম মানুষের তৈরি, অতএব তা বদলানোর যোগ্য । ঠিক কথা। কিন্তু খোদ নীতি – এই বা সেই নীতি নয়, যে কোন একটা নীতি বা স্বয়ং ধর্ম, যে কোন ধর্ম – ছাড়া মানুষের চলে না। এই অর্থে মানুষ নীতির ফসল, ধর্মের সন্তান। বিনা নীতিতে মানুষ নাই, বিনা ধর্মে সমাজ হয় না ।
মানব নয় এমন পশুদের প্রতি যথাবিহিত সম্মান দেখিয়েও বলা যায়, মানুষ ধর্মায়ত্ত, নীতির আয়ত্ত, রাষ্ট্রায়ত্ত পশু। কাজেই ধর্মই মানুষ তৈরি করেছে, নীতিই মানব সমাজের জনক, রাষ্ট্রই মানবের সারকথা ।
এই সত্যেরই সমান আরেক সত্য: পরই আপনের স্রষ্টা। তবু আমাদের সাধু- সাধকরা মাঝে মধ্যে পরম পিতাকে ডাকেন ‘সে‘ বলে নয়, ‘তুমি‘ বলে। ‘সে যদি হয় ‘পর‘, ‘তুমি‘ হয় ‘অপর‘। সাচ্চা বাত। এই সে পদকেই পুরাণ ডেকেছে ‘পুরুষ‘ নামে আর ‘তুমি‘ পদকে ‘প্রকৃতি‘ নামে।
আমরা প্রকৃতিকে ভালবেসে ‘নারী‘ বলতেই বেশি পছন্দ করি। কাজেই ‘পর‘ ও ‘অপর’ ভেদটা সহজ নহে। শাস্ত্রীয় ভাষায় এই ভেদের আরো এক নাম আছে: পর মানে ‘পরমাত্মা’, অপর মানে ‘জীবাত্মা‘। পরই আপনের আসল স্রষ্টা। অথবা জাক লাকার মতন বললে: ভাষাই বাক্যের স্রষ্টা। ‘ভাষা‘ পদের পদার্থ ‘পর’, ‘বাক্য‘ পদের পদার্থ ‘আপন‘ এবং ‘অপর’ দুই-ই। সাঁইজি বলেন:
আমি ঢাকা দিল্লি হাতড়ে ফিরি
তবু কোলের ঘোর ত যায় না!
আত্মারূপে কর্তা হরি
মনে নিষ্ঠা হলে মিলবে তারি
ঠিকানা!
বেদ বেদান্ত পড়বি যত
বেড়বে তত লখনা ।
ধড়ের আত্মা কর্তা কারে বলি
কোন্ মোকাম তার কোথায় গলি
আও না যাও না।
সেই মহলে লালন কোন জন
তাও লালনের ঠিক হল না।
(চৌধুরী ১৯৭৪: ২২)
জাক লাকাঁর লেখা সুপরিচিত। জ্ঞানী পাঠিকা জানেন – লাকাঁ যাকে ‘সাকার’ (imaginary) বলেন, লালনের ‘কোলের ঘোর‘ সেই পদার্থই। লাকাঁ যাকে নামান্তর (metonyy) বলেন, লখনা (লক্ষণা) পদের অর্থও তাই। লখনার অন্য অর্থ উপসর্গও (symptom) হয়। ধড়ের আত্মা ইমাজিনারি। ‘আত্মারূপে কৰ্ত্তা হরি‘ –কিন্তু শুদ্ধ আকার (symbolic)। কথা আজ আর বাড়াব না!
8.
অপর ও পর এর মধ্যে ভেদ করতে যে জানে না – জাক লাকাঁর মতে – তার পক্ষে আর যাই হোক মনুষ্য সমাজের শিক্ষক (analyst) হওয়া সম্ভব নয় । (লাকী ১৯৭৭: ১৪০) শিক্ষক বা সাঁইকে কথা বলতে শোনা যায় পরম সাঁই বা পরের উদ্দেশে, ‘উদ্দেশ্যে‘ নয় । তাঁর সামনে যেই শাবক বসে আছে সে ‘অপর‘। এই অপরের অলাত থেকে, এই অপরকে ভর করেই ‘পরম পর‘ অর্থাৎ ‘পরম সাঁই‘ তার সাথে কথা বলেন। কথা বলেন ভাষায় ।
এই ভাষাই ‘পরম‘ বা পরের পর। সাঁই ও শিষ্য এই ভাষার ভিতরই সঙ্গম করেন। তাই ভাষাই সত্য, একই সাথে ‘আপন’ ও ‘পর’। একমাত্র এই ভাষা হয়েই সাঁইয়ের পক্ষে সম্ভব পরম বা পরের কাহিনী শোনা।
ফরহাদ মজহার লিখেছেন (এবং এই লেখা অর্থময়):
কবি যে আনন্দে, অবচেতনে, অভিমানে, ভয়ে, আশংকায় তার সকল ইন্দ্রিয় ও উপলব্ধিসহ কবির “অপর” বা আমাদের অতি পরিচিত “তুমি”-র সঙ্গে সারাক্ষণই কথাবার্তা ডাকাডাকি কথা চালাচালি করে, সাধকের দয়ালকে ডাকা একই ব্যাপার। “তুমি” বলে যেমন কেউ নেই, তেমনি “দয়াল” বলেও কেউ নেই । নবী, গৌর, নিতাই বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে সাধক যখন আহ্বান করেন তখন এটি আবহ সৃষ্টির জন্যে, একই সঙ্গে ভাব জগতে সেই বিশাল মানুষটির অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবার জন্য । একটা ভাবগত রূপকে সহজ কল্পনার সুবিধার্থে, কিন্তু সেটা কোন ধর্মের প্রতি পক্ষপাতী হয়ে নয়। (মজহার ২০০০: ৩৬)
অন্য কথায় ভাষার প্রতি পক্ষপাতী হয়ে ।
সাচ্চা কথা । এই ভাষা কোন পদার্থ? এই ভাষার অপর নাম ইতিহাস। সাধকও ইতিহাসে বাস করেন । অর্থাৎ ইতিহাসে বিরাজ বা রাজত্ব করেন। মানুষের একদিকে আছেন পরস্বরূপ ভাষা বা পর। অন্যদিকে বিরাজ করেন আপনস্বরূপ ভাষা বা ইতিহাস ।
ইতিহাস ও পর যখন এক বিন্দুতে মিলিত হন, তখন এই সাঁই আর সেই সাঁইয়ে ভেদ ঘুচে যায়। মহাত্মা লালন ফকির সম্ভবত সেই বিন্দুর কাছাকাছি কোথাও পৌঁছেছিলেন ।
দোহাই
১. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত, লালন স্মারক গ্রন্থ (ঢাকা, ১৯৭৪)।
২. ফরহাদ মজহার সম্পাদিত, সাঁইজীর দৈন্য গান (ঢাকা, ২০০০)।
৩. Julian Baldick, Mystical Islam: An Introduction to Sufism (New York, 1989).
- Dylan Evans, An Introductory Dictionary of Lacanian Psychoanalysis (London, 1996).
৫. Jacques Lacan, Ecnits: A Selection, A Sheridan, trans. (New York, 1977).
…
উৎস
যুগান্তর ॥ ঢাকা, ১২ অক্টোবর ২০০১