“আধুনিক বাংলার আদর্শে যাঁহারা
প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করেন তাহারা পরম অনিষ্ট করেন”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ওপরের কথাগুলো বলেছি তা মনে রেখে ফকির লালন শাহের সংগৃহীত গান, সম্পাদনা ও প্রকাশ সংক্রান্ত জটিলতা সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় কলিকাতা বিশ্বদ্যিালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে লালন শাহ্ ফকিরের গান, ‘লালন-গীতিকা’। ‘লালন-গীতিকা’—য় প্রধানত মতিলাল দাশের সংগৃহীত গানই ছাপা হয়েছে। তাঁর গানই বইয়ের আগে দেওয়া হয়েছে। তারপর রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত পাঠের সঙ্গে পাঠ মিলিয়ে পাদটীকায় পাঠান্তর দেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত গানের মধ্যে কিছু কিছু অতিরিক্ত পাঠ পাওয়া গেছে। এই অতিরিক্ত পাঠও গানগুলোর সঙ্গে সংযোজন করা হয়েছে। তবে সবসময়ই সেটা সতর্ক সম্পাদনায় বন্ধনী দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।
মুখের ভাষা থেকে লিপিকরণ এবং লিপি থেকে ছাপাখানার বানান ও মুদ্রণের রীতি মেনে গানগুলোকে ‘শুদ্ধ‘ করা হয়েছে। এগুলো করেছেন পীযূষকান্তি মহাপাত্র। অর্থাৎ শেষমেষ আমরা পীযূষকান্তি মহাপাত্রের শুদ্ধ করা লালনের গান পেয়েছি। পীযূষবাবুর কাজ ছিল “যথা—সম্ভব বিশুদ্ধ পাঠ প্রতিষ্ঠিত করা, গানগুলির পতি ভাঙিয়া সাজাইয়া দেওয়া, রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত পুঁথিতে প্রাপ্ত অতিরিক্ত পদগুলো সংযোজিত করা” ইত্যাদি।
‘লালন-গীতিকা’–র ভূমিকা লিখেছেন শশিভূষণ দাশগুপ্ত। মতিলাল দাশের সংগৃহীত গানগুলির পাঠ সম্পর্কে ‘ভূমিকা’–য় শশিভূষণ বলছেন,
“ ……. সংগৃহীত গানগুলির পাঠ নানাভাবে বিকৃত ছিল; আঞ্চলিক উচ্চারণ বিধির প্রভাবে তৎসম শব্দগুলিও রূপান্তর লাভ করিয়াছিল। উচ্চারণবিকৃতি-জাত বর্ণাশুদ্ধি ব্যতীতও বর্ণাশুদ্ধি অনেক ছিল। এ-ক্ষেত্রে একেবারে ‘যদ্দষ্টং তল্লিখিতং” করিলে গানগুলির কোনও রূপ অর্থবোধ করাই কষ্টকর হইত। যেগুলি অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই বিকৃতি বা অশুদ্ধি বলিয়া মনে হইয়াছে সেইগুলিই শুদ্ধ করিয়া গানগুলিকে বোধগম্য করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইয়াছে; ইহা ব্যতীত সম্পাদনার নামে গানের উপর অযথা হস্তাবলেপ করা হয় নাই। খাতায় গানগুলি কবিতার আকারে সাজান ছিল না,-টানা লেখা ছিল, ‘পঙতি‘ ভাঙিয়া গানগুলিকে সাজান হইয়াছে। খাতায় অ-কারান্ত শব্দগুলি – বিশেষ করিয়া অকারান্ত ক্রিয়াপদগুলি ও-কারান্ত ভাবে লিখিত। সম্ভবতঃ সুরের টানে এইরূপ হইয়াছে। কবিওয়ালা ও পাঁচালীওয়ালাগণের গানেও বহুস্থলে এইরূপ দেখা যায়। এ-গ্রন্থে এই জাতীয় শব্দগুলির মধ্যে ক্রিয়াপদগুলিকে বহুস্থলে ও-কারান্তভাবেই মুদ্রিত করা হইয়াছে। মাঝে মাঝে মহাপ্রাণ বর্ণের অল্পপ্রাণ বর্ণে পরিণত হইবার প্রবণতা লক্ষিত হইবে”। ‘রবীন্দ্রসদনে’ রক্ষিত গানের খাতা উর্দুর ন্যায় ডান দিক হইতে বাঁ দিকে লিখিত; খাতার শেষ পৃষ্ঠাই প্রথম পৃষ্ঠা রূপে গণ্য। এই খাতার পাঠে আবার আর একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়; ক্রিয়াপদের আদিতে অ-কার স্থানে স্থানে এ-কার রূপে লিখিত। যেমন রাখলে –রেখলে; জানতে-জেনতে;ভাসতে-ভেসতে। মতিলালবাবুর খাতায় এগুলি আ-কারান্তভাবেই লিখিত”। [কলিকাতা ৫৮, ভূমিকা]।
একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছি এই কারণে যে আমরা যখন শ্রুতিনির্ভর সংস্কৃতির মধ্যে উৎপাদিত উচ্চারণগুলোর লিপিকরণ এবং আবার সেই লিপি থেকে নকল করে মুদ্রণযন্ত্রের দরকারে তৈরি বানান মেনে ফাঁক রেখে সরলরেখায় বাঁ থেকে ডানে টান টান ছাপবার চেষ্টা করি তখন সেই রূপান্তরে নানান বদল ঘটে যায়, সেটা অল্পস্বল্প নয়। অনেক। গ্রাম্য ও অশিক্ষিতদের ‘বিকৃত’ ও পাঠোদ্ধারের অযোগ্য হস্তাক্ষর ‘শুদ্ধ’ ভাবে ছাপার স্বঘোষিত দায় গ্রহণের পেছনে একটা প্রকট অহংকার এবং শ্রেণীগত ঘৃণার দিক তো আছেই। কিন্তু কৃৎকৌশল আমাদের অভ্যাসে যে-পরিবর্তন ঘটায় তাকে শুধু শ্রেণীর বিচার দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
এমন নয় যে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কোন কথাবার্তা বা বিতর্ক হয় নি। কিন্তু সবসময়ই সেটা শ্রেণী বিচারের প্রশ্ন হয়েই থেকেছে। আর এগোয় নি। শক্তিনাথ ঝা–এর গবেষণা গ্রন্থ থেকে আমরা জানি ভারতী পত্রিকায় যখন সরলা দেবী বাউল গান প্রকাশ করছিলেন তখন তিনি তাঁদের
“ঐতিহ্যবাহিত লেখ্যরূপের চরণবিন্যাস, কথ্য শব্দ, উচ্চারণে লৌকিক বানানরীতি যথাসম্ভব বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু প্রবাসীর বিদগ্ধ সংগ্রাহকেরা এগুলিকে সাধু বা চলিত শিষ্ট ভাবাদর্শে সংস্কৃতায়িত করলেন… মূলত শিক্ষিত সম্পাদক ও সংগ্রাহকেরা লালনের গানগুলি সংস্কৃত করে ছন্দধ্বনি নষ্ট করছেন; পংক্তি বিভাজনে বাধিত হয়েছে অর্থবোধ; লৌকিক শব্দের পরিবর্তনে ঘটে গেছে অর্থান্তর। সর্বপেক্ষা সুসম্পাদিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত লালন-গীতিকা এ পদ্ধতির আদর্শ নিদর্শন”। [শক্তিনাথ ৯৫, পৃ-১৮৪]
অথচ এর আগে লোকসাহিত্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পাঠান্তর ও বানানরীতি ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সচেতনতার নজির আছে। সেই সচেতনতা কাজে লাগানো যেত। চণ্ডীদাস পদাবলী সংগ্রহের সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“সম্পাদক মহাশয় আদর্শ পুঁথির বানান সংশোধন করিয়া দেন নাই সে জন্য তিনি আমাদের ধন্যবাদভাজন।… প্রাচীন গ্রন্থাদির আধুনিক সংস্করণে বানান- সংশোধকগণ কালাপাহাড়ের বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলেন… তাহারা সংস্কৃত বানানকে বাংলা বানানের আদর্শ কল্পনা করিয়া যথার্থ বাংলা বানান নির্বিচারে নষ্ট করিয়াছেন।… ইহাতে ভাষাতত্ত্ব জিজ্ঞাসুদের বিশেষ অসুবিধা ঘটিয়াছে।… আধুনিক বাংলার আদর্শে যাঁহারা প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করেন তাহারা পরম অনিষ্ট করেন”। [ রবীন্দ্র রচনাবলী ১৪ দশ খণ্ড, পৃ-১০৪; শক্তিনাথের ব্যবহৃত উদ্ধৃতি থেকে]।
শক্তিনাথ যেটা লক্ষ করেছেন সেটা হোল, “জগৎবিখ্যাত হয়ে রবীন্দ্রনাথ এ চেতনা বর্জন করে, প্রবাসীর ভদ্রলোকদের গ্রাম্যগান গান সংগ্রহের সংস্কৃতায়িত রীতি গ্রহণ করলেন”। বেশ কড়া অভিযোগ ।
শক্তিনাথই যে প্রথম শিক্ষিত ভদ্রলোকদের গান সংগ্রহ ও সম্পাদনার সমস্যা তুলে ধরেছেন তা নয়, এর আগে আরো অনেকেই, যেমন সনৎ মিত্রও তুলে ধরেছেন। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন সাধারণ ভাবে লোকগান সংস্কারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সেটা পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ নির্ণয়ের সমস্যা ছিল না। কিন্তু শক্তিনাথই গুছিয়ে ভদ্রলোকদের সংস্কারের কারণে এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো সচেতন মানুষের সম্পাদনায় প্রকাশিত লালনের গানে ধ্বনি, সুর ও ভাবের ক্ষতি সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনা রীতির পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন:
এক: কলিবিভাগের জন্য এক দাঁড়ি, দুই দাঁড়ি বা সংখ্যার নিয়মের পরিবর্তে গীতাঞ্জলির গানের মতো করে লালনের গান ছাপানো। কমা, সেমিকোলন, দাঁড়ি ব্যবহার। এই সমালোচনা সঠিক, কিন্তু শক্তিনাথের সঙ্গে আমরা এই ক্ষেত্রে একটি জায়গায় একদমই একমত নই। শক্তিনাথ প্রচ্ছন্ন ভাবে লিপিকেই শ্রুতি ও স্মৃতির সংস্কৃতির বিশ্বাসযোগ্য বাহন মনে করছেন। তাহলে কি রবীন্দ্রনাথের উচিৎ ছিলো লালনের আখড়া বা ভোলাই শা-র খাতায় যেভাবে শ্রোতার সামনে বসে—মুখে—গাইবার গানগুলি লেখা হয়েছে ঠিক সেই ভাবেই গানগুলো ছাপানো? কণ্ঠ ও কান যেখানে গানের মাধ্যম সেই মাধ্যমের চেয়ে ভোলাই-শার খাতার লিপি অধিক প্রামাণ্য হতে পারে না। গানের বাহন হচ্ছে সুর, গাইবার ভঙ্গি এমনকি গানের পরিবেশ এবংপরিস্থিতি। সেই জগত যদি না থাকে ছাপাখানা কি তাকে ছেপে রাখতে পারবে? শক্তিনাথ যাদের সমালোচনা করেছেন তাঁদেরই অভ্যাসের কাছে নিজে ধরা খেয়ে রয়েছেন। লিপিকৃত বা ছাপানো গানকেই প্রামাণ্য জ্ঞান করেছেন। শুধু পার্থক্য কার লিপি আর কীভাবে সেটা ছাপা হোল। ভোলাই শা-র খাতার ওপর ভর করলে এবং লিপিকরের বানান ও বাক্য সাজানো অনুসরণ করলে তাঁর আর আপত্তি থাকতো না।
রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসীতে ছেপে কলকাতার শিক্ষিত বাবুদের ফকির লালন শাহের গান শোনানো। ‘শোনানো‘ কথাটা লিখেছি বলে অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই। ছাপা অক্ষর পাঠ মানেই চোখ দিয়ে শোনা। তাহলে লালনের গানের মধ্যে কবিতার দিকটা – গানটি না গেয়ে শুধু ছেপে দিয়ে কবিতার স্বাদ দেওয়া তাঁর লক্ষ ছিল। তিনি সফল হয়েছেন বলেই আমাদের ধারণা। এখন প্রশ্ন, ক্ষতি কি হয়েছে? হ্যাঁ, অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে দোষ ছাপাখানার না রবীন্দ্রনাথের, সেই বিষয়ে একটা তর্ক হতেই পারে। দরকারও আছে বলে আমরা মনে করি।
তবে আমাদের জন্য প্রধান প্রশ্ন হোল, ফকির লালন শাহের গান শুধু সুর বা গান নিশ্চয়ই নয়। ওর ভাবগত দিকটা রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলীর আদর্শে কমা—সেমিকোলন দিয়ে অস্পষ্ট করে দিলেন কিনা। প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথের সমস্যা আকারে না দেখে সাধারণ সমস্যা আকারে দেখা যাক। ছাপাখানা শ্রুতি আর স্মৃতির সংস্কৃতির মধ্যে তৈরি বিষয়, ভাব বা দর্শনকে কি স্পষ্ট করে তোলে নাকি আরো অপরিচ্ছন্ন করে তোলে। এটি খুবই বড়ো একটি বিতর্ক যার মধ্যে আমাদের প্রবেশ করতেই হবে। কিন্তু এখনই যার চাঁচাছোলা উত্তর আমাদের নেই। যেটা আমরা বুঝতে পারছি তা হোল, শ্রুতি আর স্মৃতির সংস্কৃতির ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাপাখানা যা তৈরি করে সেটা একদমই নতুন বিষয়। মাধ্যম যাকে বহন করে তার চরিত্রেও বদল ঘটিয়ে দেয়। নতুন চিহ্নব্যবস্থায় নতুন অর্থ হয়তো আমরা তৈরি করি। ক্ষতি কি? ছাপা অক্ষরে ভাবচর্চার ক্ষেত্রে শ্রুতি ও স্মৃতির সংস্কৃতির সঙ্গে কী ধরণের সম্পর্ক এই কালে সবচেয়ে ফলপ্রসূ আমাদের সংগ্রামের জন্য সেটাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেটাই আমরা প্রধান বিবেচনার বিষয় বলে মনে করি।
দুই: রবীন্দ্রনাথ কথ্য আঞ্চলিক ভাষাকে শিষ্ট চলিত ভাবাদর্শে মার্জিত করেছেন। এটা রবীন্দ্রনাথ হয়তো অন্যায় করেছেন এই অর্থে যে শ্রেণীগত দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের ভাষা বড়লোকদেরই ভাষা। ফলে নিম্ন বর্গ, নীচু শ্রেণী বা ছোটলোকের ভাষাকে তার নিজস্ব গরিমায় না দাঁড়াতে দিয়ে সংস্কার করাটা আভিজাত্যের অহংকার অবশ্যই। কিন্তু শক্তিনাথ, আবদুল হাই প্রমুখের বরাতে কুষ্টিয়ার কথ্য ভাষায় লালনের গান রচনার কথা বলেছেন। লালন তাঁর অধিকাংশ গান এই ভাষাতেই হয়তো লিখেছেন। যদিও এই ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আছে। আমরা আমাদের নবপ্রাণ আখড়াতে দেখেছি নরসিংদির সাধু কি সিলেট বা নোয়াখালির লালন ভক্তরা যখন তাঁদের সাঁইজীর গান গাইছেন তখন তাঁদের আঞ্চলিক উচ্চারণের টান পুরোমাত্রায় বজায় রেখেছেন। অপূর্ব লাগে। একাট্টা এক ধরণের প্রমিত ভাষার ধারণাটা ছাপাখানার সংস্কৃতি থেকে তৈরি। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন জীবন্ত মানুষের উচ্চারণ এক হতে পারে না। আর ঠিক এই বৈচিত্র্যই তো সাধকদের আনন্দ। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই তো সেই ‘অধরা’ যাঁকে তাঁরা সন্ধান করেন। কুষ্টিয়ার ভাষাতেই গান লিখতে ও গাইতে হবে বলা মানে কলকাতার ভাষায় যেভাবে আমাদের বাংলা ভাষা বলতে ঐতিহাসিক ভাবে বাধ্য করা হয়েছে, সেই প্রকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা। সাধকের জগতে এই একনায়কতন্ত্র খাটে না।
বাংলা ভাষার যে-চলিত রূপটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে দানা বেঁধেছে তাহলে কি তাকেও তার শ্রেণীর অভ্যাসটা বাদ দিতে হবে? কুষ্টিয়ার ঢংকেই লালন গানের আদর্শ জ্ঞান করে ঠিক সেই ভাবেই গাইতে হবে? এই যুক্তি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে সেই গাওয়াটা হবে কৃত্রিম। আমি একবার ঢাকার একজন ‘শিক্ষিত’ সাংস্কৃতিক কর্মীর মুখে লালনের একটি গান শুনে এই বিষয়ে আরো নিশ্চিত হয়েছি। তিনি লালনের ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে‘। শহুরে প্রমিত বাংলার ছাঁদে ফেলে গানটি গাইলে কোনই অসুবিধা নাই। কিন্তু লালনের গানকে ‘পল্লীগীতি’ জ্ঞান করে তিনি প্রতিটি শব্দ বিকৃত করে গাইছিলেন। যেমন ‘নদে’–কে ‘নইদ্যে’, পাগলকে ভারি অদ্ভুত ‘ফ’ এবং ‘প’র মধ্যবর্তী উচ্চারণে, ‘মেল’–কে ‘ম্যাইলা’, ইত্যাদি। অথচ এর কোন দরকারই নাই।
প্রশ্ন হচ্ছে যাঁরা শহুরে প্রমিত ভাষায় গানবাদ্য করেন, তাঁরা কি এই ধরণের বিকৃত উচ্চারণ না করতে পারলে গান গাইবেন না? পল্লীগীতির ক্ষেত্রে এই ধরণের একটা চল রয়েছে। গানের ছন্দ, ধ্বনি, সুর, স্বরবিন্যাস ইত্যাদি নানান কারণে স্থানীয় উচ্চারণ বিধি মানা ভাল। সুন্দরও লাগে। কিন্তু ফকির লালন শাহের গানের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তাটা পরিষ্কার নয়। ফকির লালন শাহের গান তো পল্লী গীতি নয়। এই ক্ষেত্রেও আমাদের বিচার্য হবে প্রতিটি শব্দ কুষ্টিয়ার ভাষার মধ্যে যে-ভাবগত তাৎপর্য ধারণ করে সেই তাৎপর্য উচ্চারণে বিচ্যুত হয় কিনা। কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষাকেই লালন গানের আদর্শ জ্ঞান করলে হয় তো সাঁইজী নিজেই খুব দুঃখ পেতেন। প্রতিটি উচ্চারণ নিজের জগতের মধ্যে সাঁইজীর ভাবকে কীভাবে অনুবাদ করে নিচ্ছে সেটাই বিচার্য বিষয়। সকলেই যেন সহজ স্বাভাবিক ও সাবলীল ভাবে ফকির লালন শাহের গান গাইতে পারেন সেই শর্ত জারী রাখা দরকার। বড়োজোর অভিজ্ঞতার আলোকে একটা সীমানা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে।
তিন: গানের পদ থেকে কোন কোন শব্দ বাদ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। স্থানাবিশেষে নতুন শব্দ ঢুকিয়েছেন। এটা ভয়াবহ। এটা কিছুতেই চলবে না। ঠিক সেই কারণেই আমরা আগে বলেছি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবি প্রতিভা দিয়ে সম্পাদনা করেছেন, লালনের ভাবগত দিকটা তাঁর অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল না। ভোলাই শাহের খাতায় ১৫৬ নম্বর গান হোল, “আৰ্ত্তা (আত্মা) রূপে কর্তা হরি মনে নিষ্ঠা হইলে মিলবে তারি ঠেকনা বেদবিদান্ত পোরবে জত বেড়বে কতো লকনা (লক্ষণা)”। অধরাই যে আত্মারূপে কর্তা হয়েছে নিষ্ঠা হলে তার ঠিকানা হবে বা মীমাংসা হবে। হাজার বেদবেদান্ত পড়লে বা বইপত্র শাস্ত্রাদি পাঠ করলে হবে না। কারণ “গৌণ লক্ষণার্থ পাঠকের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাকে ঘিরে ফেলে, আচ্ছন্ন করে”। নিষ্ঠাহীন শাস্ত্রাদি পাঠ বা তত্ত্বচর্চা প্রজ্ঞার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথ “বেড়বে” কথাটির ভাবগত দিক ধরতে পারেন নি। বদলিয়ে লিখেছেন “বাড়বে”। শক্তিনাথ এই সকল নজির দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনার মারাত্মক বিচ্যুতিগুলো ঠিকই ধরেছেন। এই ক্ষেত্রে আমরা তাঁর সঙ্গে একদমই একমত। এমন কি ভোলাই শা-র খাতায় “আমার এ ঘরখানা কে বিরাজ করে”-র জায়গায় আমার এ “ঘরখানায়” কে বিরাজ করে ধরণের পরিবর্তনেও যে অর্থবিপত্তি ঘটাতে পারে সেই দিকটা তিনি উল্লেখ করে খুবই সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন। নিছকই “য়” থাকা না থাকার প্রশ্ন মাত্র নয়, কোথায় গানটি গাইবার সময় বিরতি নির্দেশ করে তার সঙ্গে অর্থ উৎপাদনের সম্পর্ক শ্রুতি ও স্মৃতির সংস্কৃতির মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
চার: অনেক শব্দের সঠিক পাঠ রবীন্দ্রনাথ উদ্ধার করতে পারেন নি। এটা অবশ্য অপরাধ নয়, কোনভাবেই। সেই ভুল যে কেউই করতে পারে। বিশেষত “রাইরাঙ্গা” শব্দটি। ভোলাই শা-র খাতার ৩৩ নম্বর গানে আছে “ত্রিজগতে যে রাইরাঙ্গা, তার দেখি ঘরখানি ভাঙ্গা, হায় কি মজার আজব রোঙ্গা, দেখায় ধনি কোন ভাবে ঃ।। “জীবনানন্দ দাশ “রায় রায়ান” ব্যবহার করে অবশ্যই কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এই গানটি শুদ্ধ করে ছাপতে গিয়ে “রায় রাঙ্গা” করেছিলেন। “রাইরাঙ্গা” শব্দটি নিজেই “ভাঙ্গা” ও “রোঙ্গা”–র অন্ত্যমিলের সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরো দুর্দান্ত অর্থোৎপত্তির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
পাঁচ: রবীন্দ্রনাথের “জীবনবিশ্বাস ও মূল্যবোধ লালন থেকে বিলক্ষণ স্বতন্ত্র ছিল”। অবশ্যই। ফকির লালন শাহের কবিতা এবং গান তাঁর ভাল লেগেছে, সেটা সত্যি। কিন্তু বুঝতে পারেন নি এগুলো তাঁর কবিতা বা গানের মতো নিছকই পদ্য বা গান নয়। প্রতিটি গানই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটা ভাবগত, জ্ঞানগত এবং নান্দনিক ভিত্তির ওপর শুধু দাঁড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে সুর্দিষ্ট চর্চার দিকও জড়িত। ওদের পেছনে আছে বাংলার বহুবছরের ভাবচর্চার ইতিহাস। সাংখ্য, বৈশেষিক, বৌদ্ধ, জৈন, নাথপন্থী, শাক্ত, বৈষ্ণব, সুফি ইত্যাদির অভিঘাত। ওর মধ্যে মোটা দাগে রয়েছে নদীয়ার ভাব এবং ওরই মধ্যে বিশিষ্টভাবে লালন নিজে। যে গৌরাঙ্গকে নদীয়ায় “নতুন ভাব” এনেছে বলে ঘোষণা করেছেন, সেই ভাবটা আসলে শুধু তাঁর চোখেই পড়েছিল। ফলে স্বয়ং তাঁকেই, ফকির লালন শাহকেই সেই ভাবটা নিজের মধ্যে প্রকাশ করে দেখাতে হোল। বৈষ্ণব ভক্তি বা রসতত্ত্ব অতিক্রম করে সাঁইজী যে ভাবের কথা বলেছেন সেটা বাংলায় নতুন। গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, বীরভদ্র, মাধব বিবি সেই ভাব আবির্ভাবের শর্ত তৈরি করে দিয়েছেন সত্যি, কিন্তু ভাবটা ফুটিয়ে তুলেছেন লালন। এমন একটি সন্ধিক্ষণের কালপর্বে তাঁকে সেটা করতে হয়েছে যখন শ্রুতি ও স্মৃতির সংস্কৃতির পাশাপাশি বেড়ে উঠছে ছাপাখানার জগত। ছাপাখানায় রবীন্দ্রনাথের মতো কবিদের জন্ম হচ্ছে। অবতারের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। গুরুবাদের স্থান দখল করে নিচ্ছে বই, পত্রিকা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পুরনো জাত, বর্ণ, শ্রেণী ও লিঙ্গের বিরোধের পাশাপাশি দানা বেঁধেছে নিরক্ষর আর স্বাক্ষরের বিরোধ, শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের দ্বন্দ্ব। এই লড়াইতে নিরক্ষর, গরিব আর নির্যাতিত মানুষগুলো হেরে যাচ্ছে। ফকির লালন শাহ আর রবীন্দ্রনাথের জগত একদমই আলাদা। এই হিশাবে দুই জনে দুই মেরুর মানুষ।
তবুও রবীন্দ্রনাথ লালনকে বুঝতে না পারার পেছনে কিছু সহজবোধ্য কারণ আছে। রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক প্রশ্নগুলো ছিল কবির প্রশ্ন, ঠিক ভাবুকের নয়। ফলে সেই সকল প্রশ্ন চিন্তার মীমাংসা সাধনে উদ্যোগী নয়, কাব্য স্বাদ দিতে উৎসাহী। উপনিষদ তিনি তাঁর গদ্যে ও কবিতায় ব্যবহার করেছেন, তবে সেটা নিছকই তাঁর রচনার অলংকার হিশাবে, উত্থাপিত কোন প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য নয়। তবুও সেগুলো কবির রচনা হিশাবে আমাদের যথেষ্ট কাজে দিয়েছে, কিন্তু ভাবুকতার উপাদান হিশাবে বাজারে চালাতে গেলে তামার পয়সায় বেশি দাম দিয়ে কেউ কিনতে রাজি হবে না।
কবি মাত্রই ভাবুক হতে হবে এই দাবি হয়তো অন্যায়, কিন্তু ভাবুককে কবির স্তরে নামিয়ে আনাটা আরও বড়ো ধরণের অন্যায় ও অপরাধ। সজ্ঞানে ফকির লালন শাহকে রবীন্দ্রনাথ এই স্তরে নামাবার চেষ্টা অবশ্যই করেন নি. এটা পরিষ্কার। কিন্তু শক্তিনাথের অভিযোগ একদমই সত্যি যে লালনের গান সংস্কার, পরিবর্তন ও পরিবর্জনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেরই নিজস্ব জীবনবিশ্বাস ও মূল্যবোধ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। লালনের ভাবকে অক্ষত হাজির করার দায় তিনি বোধ করেন নি। এই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে ভয়ানক অপরাধ করেছেন যা কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। শক্তিনাথ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ লালনের একটি গান এমন ভাবে সম্পাদনা করেছেন যাতে লালন যখন প্রত্যক্ষভাবে ইষ্টকে পাবার কথা বলছেন, পরকাল ও পরলোককে অস্বীকার করছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ এই সাধকের পরকাল ও পরলোকের অস্বীকৃতিটুকু সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন। নিজে পরকাল ও পরলোকে বিশ্বাসী হওয়ার কারণেই কি তিনি এই সাধকের ইহলৌকিক চিন্তা গ্রহণ করতে পারেন নি?
তবে “এমন মানব জনম আর কি হবে” গানটির ক্ষেত্রে শক্তিনাথ যে-অভিযোগ তুলেছেন সেটা আমরা মানতে পারছি না। শক্তিনাথ বলছেন, “ভণিতায় ছিল, ‘অধীন লালন তাই ভাবে‘। গুরুর এই অধীনতা অস্বীকার করে রবীন্দ্র পদটি লিখলেন, ‘লালন কয় কাতর ভাবে‘। শক্তিনাথেরই সম্পাদিত ভোলাই শা-র খাতায় গানটির দুটো ভাষ্য আমরা দেখছি ( ৪নং এবং ৩২২ খ নং)। ৪ নং গানে ভণিতা বাক্যটি হচ্ছে “এবার ঠকিলে আর না দেখি কিনার, লালন কয় কাতর ভাবে”। দুই তিনটি খাতার পাঠ মিলিয়ে একটা চূড়ান্ত পাঠ রবীন্দ্রনাথ স্থির করার সম্ভাবনার কথা শক্তিনাথ নিজেই বলেছেন। হয়তো দু তিনটি পাঠ মিলিয়ে সম্পাদনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মুশকিলে পড়েছিলেন, অতএব “অধীন লালন” সম্বলিত ভণিতাংশ গ্রহণ না করে ‘লালন কয় কাতর ভাবে‘ ভণিতাটি রেখেছেন। যদিও এই পছন্দের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের ভাবগত বিচারের মানদণ্ডটা ধরা পড়ে। তবু রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি দোষী বানাতে আমাদের বাধছে। তাঁর রোমান্টিকতায় ফকির লালন শাহের “মানুষ” ধারণাটির তাৎপর্য অনুধাবন অসম্ভবই ছিল। সেই কারণে ‘মানুষ‘ শব্দটি বদলিয়ে ‘মানস‘ শব্দটি বসানোর গুরুতর ভাবগত বিপত্তি তাঁর বিচারে ধরা পড়ে নি। রক্তমাংসের মানুষের অর্থাৎ “দেহী মানুষের এ মহিমাকে, “ইচ্ছা” থেকে সৃষ্টির ভাববাদী সূক্ষ্ম আবরণে আচ্ছাদিত করলেন রবীন্দ্রনাথ” [শক্তিনাথ ৯৫, পৃ-১৮৬]। শক্তিনাথের এই অভিযোগ সঠিক ও ন্যায্য।
কিন্তু এতো কিছু চোখে ধরা পরার পরেও আমরা অবাক হয়েছি শক্তিনাথ ঝা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে বাউল এবং লালনের প্রভাব তাঁর গবেষণায় দেখাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। শুধু অবাকই নয়, কিছুটা কৌতুককরও মনে হয়েছে। খুব পরিশ্রম করে কোথায় কোথায় রবীন্দ্রনাথ বাউলদের কথা বলেছেন, বাউল হয়েছেন প্রভৃতি পুরনো প্রসঙ্গই আবার শক্তিনাথ নিজের ভাষায় বলেছেন। বাউলদের প্রতি কবি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ও আন্তরিকতার অভাব ছিল না, ফলে বাউলেপনার প্রতি একটা রোমান্টিক মোহ তাঁর ছিল। একটা বিস্ময় ও শ্রদ্ধাও তাঁর ছিল। তাঁর লেখালিখিতে সেসব আছে। এগুলো খুবই গৌণ উপাদান। এই জগত সম্বন্ধে তাঁর ন্যূনতম কোন ধারণা ছিল না। বাউলদের জীবনযাপনের সঙ্গে ভাবুকতার মীমাংসিত ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো কীভাবে সম্পর্কিত সেটা রবীন্দ্রনাথের বোঝার মতো কোন বাস্তবতাও ছিল না। ফকির লালন শাহকে বোঝা ছিল আরও অসাধ্য কাজ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও বাংলার ভাবান্দোলন তো এক জিনিস নয়। আজ অবধি ঐতিহাসিকেরা এই দুটো ব্যাপারকে লেজেগোবরে করে রেখেছেন। দীনেশচন্দ্র সেনের মতো অসাধারণ মানুষটিও একই ভুল করেছেন। অতএব রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে গল্পে বাউলেপনা এসেছে, কিন্তু কখনোই বাউল আসে নি, তাদের ভাব আসে নি। হয়তো আসতে পারত যদি রবীন্দ্রনাথ বাউলদের ভাবগত চর্চার সঙ্গে তাদের কর্ম ও জীবনযাপনের সম্পর্ক উভয়ের অবিচ্ছেদ্য যোগটা অন্তত ধরতে পারতেন। বুঝতেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটা আশা করা অন্যায় । তাছাড়া কী করেই বা আসবে ? শক্তিনাথ নিজেই মনসুর উদ্দীনের ‘হারামণি‘-র শুভেচ্ছা লিপি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন যে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, “উপনিষদের মনের মানুষের সন্ধান বাউল করে”। বাউলেরা আজীবন বেদ, শাস্ত্র গ. উচ্চবর্ণের চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে লড়েছে। ফলে উপনিষদের সঙ্গে বাউলদের মিল দূরে থাকুক, বাউল বরং তার ঘোরতর বিরোধী। রবীন্দ্রনাথ বাউলদের ভাবগত দিকটা বুঝতে পারলে এই ধরণের অতিশয় তরল ও হাল্কা মন্তব্য করতেন না। কিম্বা সেই অহংকারও তাঁর কখনই হোত না যে তাঁর চিন্তায় বাউলের বাণী সহজ হয়ে মিশে গিয়েছে। বাউলদের গানের কিছু শব্দ, অক্ষর, কিছু সুর তার গায়ে জলের ছিটার মতো লেগেছে বড়ো জোর। বাংলার ভাবান্দোলনের ভাবের সমুদ্রের ধার দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোথাও হেঁটেছেন তার নজির রবীন্দ্র রচনার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দরকারই বা কি? জমিদারির কাছারিতে বসে গান সংগ্রহ করেছেন। এটাইতো যথেষ্ট। আর কেন? যদি বাউলদের ভাবের সাগরে হাঁটতেন, তাহলে শক্তিনাথের এতোটুকু অন্তত বোঝা দরকার ছিল, রবীন্দ্রনাথ লালনের গান সম্পাদনার ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুলগুলো করতেন না। রবীন্দ্রনাথ আর বাউল দুটো দুই মেরুর ব্যাপার।
অতএব শক্তিনাথ যখন দাবি করছেন, “রবীন্দ্রনাথ এবং লালন একাকার হয়েছিল রবীন্দ্রচিন্তায়” তখন তাঁর এই ঘোষণা অতিশয় হাস্যকর একটি মন্তব্য হয়ে ওঠে। আমরা তখন তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা স্ববিরোধী টেনশন লক্ষ করি। একদিকে তিনি ফকির লালন শাহের গান লিপিকরের বানান, যতিচিহ্ন ও ঠিক-বেঠিক শব্দ সহ রক্ষা করার জন্য উদগ্রীব। সেই কাজ করতে রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না। কিন্তু দাবি করছেন রবীন্দ্রচিন্তায় বাউল আর লালন একাকার। তাহলে লালনের গান নিয়ে এতো পরিশ্রমের কি দরকার? রবীন্দ্রনাথ পাঠ করলেই তো যথেষ্ট। নিজের গানের ওপর ফকির লালন শাহের স্বত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই কি এতো পরিশ্রম? লালনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিখ্যাত করেছেন সেই কেচ্ছা আমাদের এখনও শুনতে হয়। এখন লালন আর রবীন্দ্রনাথ একাকার হয়ে যাবার গল্পটাও শক্তিনাথের মুখেই শুনতে
হোল।
তবু স্বীকার করতেই হবে শক্তিনাথ ঝা একটি অসামান্য কাজ করেছেন, তিনি সত্যি সত্যিই গ্রামেগঞ্জে বাউলদের সঙ্গে ঘুরেছেন। তথ্য সংগ্রহের পরিশ্রম তাঁর বইয়ের সর্বত্র পরিস্ফুট। কিন্তু কলকাতার বাবুটি কিম্বা রাবীন্দ্রিক “মনের মানুষ” কিন্তু কলকাতাতেই রয়ে গেল গ্রামে আর বসতি নিল না। সযত্নে মনের মধ্যে সেই ধারণাটাই আগলে রেখেছেন যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনায় ফকির লালন শাহকে একাকার না করলে বুঝি ফকিরফ্যাকড়ার সম্মান রক্ষা হয় না। বুঝি রবীন্দ্রনাথের ‘মনের মানুষ’ আর ফকির লালন শাহের ‘মনের মানুষ” একই কথা। আক্ষরিক অর্থই বুঝি উভয়ের ভাবার্থও বটে। এই মানসিকতা যতো দ্রুত আমরা ত্যাগ করতে পারি ততোই লালন গবেষণা তার নিজের মর্যাদায় দাঁড়াবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
একটু সময় নিয়ে শক্তিনাথের কাজের পর্যালোচনা আমরা করেছি। ফকির লালন শাহের গান সম্পাদনা ও সংকলনের সমস্যাগুলো তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন সেটা বাস্তব। তাঁর সঙ্গে কোথায় আমরা একমত, কোথায় অমত, বিনয়ের সঙ্গে সেটাও বলা হোল। আশা করি আমাদের অবস্থানও পাঠকদের কাছে সাফ হয়েছে।