রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালন শাহ ফকিরের কুড়িটি গান সর্বপ্রথম ‘প্রবাসী’র ‘হারামণি’ শীর্ষক বিভাগে প্রকাশিত হয় (প্রবাসী, ১৩২২, আশ্বিন-মাঘ সংখ্যা)। ইহার পূর্বে লালনের দুই-চারিটি গান কোনো কোনো সংগীত-সংগ্রহে স্থান লাভ করিতে পারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম অতগুলি গান প্রকাশ করিয়া লালনের প্রতি সকলের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেন। এই গানগুলি খুব সম্ভব লালনের আখড়ায় রক্ষিত একটি খাতা হইতে নকল করিয়া লওয়া হয়, পরে রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধ আকারে সেগুলি প্রকাশ করেন।
ছেলেবেলা হইতে দেশের নানা মুসলমান ফকিরের মুখে লালনের গান শুনিয়া আসিতেছি। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে লালনের বিষয় জানিবার জন্য খুবই আগ্রহ হয়। ১৯২৫ সালে ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত লালনশাহী মতের ফকির হীরু শাহের সঙ্গে বাড়ী হইতে দশ মাইল পথ হাঁটিয়া লালনের সেঁউড়িয়া আখড়ায় উপস্থিত হই। ঐ দিন ছিল আখড়ার বাৎসরিক উৎসব। প্রতি বৎসর অম্বুবাচি প্রবৃত্তির দিন ঐ উৎসব হয় । নানা অঞ্চল হইতে বহু লালনপন্থী ফকির সমবেত হইয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত গান ও তত্ত্বালোচনা করে । ঐ উৎসবের ফকিরদের মুখে শুনিয়া কতকগুলি গান লিখিয়া লই। উহাই আমার লালনের গান- সংগ্রহের প্রথম প্রচেষ্টা।
ঐ সময়ে আশ্রমে রক্ষিত একখানা পুরানো গানের খাতা দেখি । উহা নানাপ্রকারের ভুলে এমন ভর্তি যে, প্রকৃত পাঠোদ্ধার করা বহু বিবেচনা ও সময়সাপেক্ষ। আশ্রমের কর্তৃপক্ষেরা বলে যে, সাঁইজীর আসল খাতা শিলাইদহের ‘রবি বাবুমশায়‘ লইয়া গিয়াছেন । (শিলাইদহের জমিদারীর অধীন অঞ্চলে সাধারণ লোকেরা রবীন্দ্রনাথকে ‘বাবু মশায়‘ বলিয়া অভিহিত করিত—সেঁউড়িয়া রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর অন্তর্গত ছিল) লালনের শিষ্যেরা আবার সেই গানগুলি বর্তমান খাতায় লিখিয়া রাখিয়াছে। তাহারা আরো বলে যে, সাঁইজীর সেই গানের খাতা পাইয়াই রবীন্দ্রনাথ অত বড়ো কবি হইয়া সকলের প্রশংসা লাভ করিয়াছেন। রবীন্দ্রসাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞানহীন, অশিক্ষিত ফকির সম্প্রদায়ের এই প্রকার গুরুভক্তি দেখিয়া সেদিন মনে-মনে হাসিয়াছিলাম ।
তারপর ১৯৩৬ সাল হইতে কুষ্টিয়ায় যখন স্থায়ীভাবে বাস করিতে আরম্ভ করি, তখন লালনের সমস্ত গান পূর্ণাঙ্গ ও শুদ্ধরূপে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করি। তখন ঐ খাতাখানি আর একবার দেখিবার প্রয়োজন হইলে আখড়ার তদানীন্তন মালিক ভোলাই শা ফকির বলে যে ঐ খাতা মুন্সেফ মতিলাল বাবু লইয়া গিয়াছেন, তিনি উহা দেখিতে লইয়া আর ফেরত দেন নাই । সুপণ্ডিত শ্রীযুক্ত মতিলাল দাশ মহাশয় কিছু পূর্বে কুষ্টিয়ায় মুন্সেফ ছিলেন । মতিলাল বাবু যে খাতা লইয়া যান নাই, সে খাতা লালনের আস্তানাতেই আছে, তাহার প্রমাণ শীঘ্রই পাওয়া গেল । যাহোক, সেই খাতা দেখিবার আবার সুযোগ মিলিল। তখন সেই খাতার সহিত মিলাইয়া শুদ্ধ আকারে দুই শতের কিছু অধিক গান সংগ্রহ করিয়া রাখি । তাহাতে একটা বিষয় লক্ষ্য করি, যে-সব গান ছেলেবেলা ফকিরদের মুখে শুনিয়া আসিতেছি, তাহার কতকগুলি গান ইহার মধ্যে নাই। এই খাতা যে নানা- প্রকারের ভুলে ভর্তি ও তাহার পাঠোদ্ধার সহজসাধ্য নয়, তাহা শ্রীমতিলাল দাশ মহাশয়ও বলিয়াছেন লালন সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধে (বসুমতী : শ্রাবণ, ১৩৫১)। যাহোক, ঐ খাতার সহিত মিলানো ও খাতার বাহিরের ফকির-গায়কের মুখ হইতে শোনা প্রায় তিনশত গান সংগ্রহ করিয়া রাখি।
তারপর লালনের গান-সংগ্রহের ও লালনশাহী ফকিরদের সংস্পর্শে আসিবার বিষয় সুযোগ ঘটে শিলাইদহে নিখিল-বঙ্গ-পল্লীসাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে। কুষ্টিয়া অঞ্চল কেবল ভৌগোলিক সংস্থানের জন্যই নহে, অন্যান্য বিশেষ কারণেও নদীয়া, যশোহর, ফরিদপুর, পাবনা প্রভৃতি জেলার কেন্দ্রস্থল। সমস্ত জেলার মুসলমান ফকির ও বাউলপন্থী হিন্দু বৈষ্ণব প্রভৃতির ধর্ম-সাধনা-বিষয়ে অনুপ্রেরণারও এইটি একটি কেন্দ্রস্থল । লালন ও বহুসংখ্যক ঐ মতাবলম্বী ফকির এবং গোঁসাই গোপাল ও অন্যান্য বহু বাউলপন্থী রসিক বৈষ্ণবের বাস ও লীলাস্থল এই কুষ্টিয়া অঞ্চল। লালনের তিরোধানের পরবর্তীকালে পাঞ্জ শাহ (কুষ্টিয়া হইতে পাঞ্জ শাহের বাসস্থলের দূরত্ব ২০ মাইলের বেশী নয়, যদিও ইহা যশোহর জিলার মধ্যে অবস্থিত) বিশেষ প্রসিদ্ধ লাভ করেন এবং এই অনুপ্রেরণার ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। কুষ্টিয়া অঞ্চল হইতেই এই ভাবধারা চতুষ্পার্শ্ববর্তী জেলায় ছড়াইয়া পড়ে এবং অনেক মুসলমান ও হিন্দু জাতীয় বাউলের উদ্ভব সম্ভব হয়। তারপর এই অঞ্চলের কবিগান, জারিগান, মনসার ভাসান গান, গাজীর গীত, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতি প্রসিদ্ধ এবং প্রায় পল্লীতেই এইসব গানের একাধিক দল দেখা যায় । এই অঞ্চলের সমস্ত ফকির ও বৈঞ্চবদের এবং এইসব পল্লী-শিল্পীদের উৎসাহ ও প্রেরণা দিবার জন্য আমরা কয়েকজন মিলিত হইয়া ইহাদের সমাবেশের একটা ব্যবস্থা করি । কবি-তীর্থ শিলাইদহ এই সমাবেশের স্থান নির্দিষ্ট হয় এবং নিখিল- বঙ্গ-পল্লীসাহিত্য সম্মেলন নামে এক সম্মেলন আহূত হয় (১৯৪০ সালের মার্চ মাসে)। বাংলার নানাস্থান হইতে নিমন্ত্রিত হইয়া সাহিত্যিকগণ এই সম্মেলনে যোগদান করেন এবং সপ্তাহব্যাপী বাউল গান, জারি গান, মনসার ভাসান গান, গাজীর গীত প্রভৃতি উৎসবের অনুষ্ঠান হয় । এই সম্মেলনের অভ্যর্থনা-সমিতির সভাপতি ছিলাম আমি এবং সম্পাদক ছিলেন শিলাইদহনিবাসী সুসাহিত্যিক শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারী। শচীন্দ্রবাবুর অদম্য উৎসাহ, অক্লান্ত পরিশ্রম ও অপূর্ব সংগঠনশক্তিতে এই সম্মেলন এই অঞ্চলের একটি স্মারণীয় ঘটনা হইয়া রাহিয়াছে। (ইহার দীর্ঘ বিবরণ ও কতকগুলি ফটো ইং ৩১/৩/৪০ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল)।
এই উপলক্ষে বাংলার বহুস্থানের বাউলদের এবং বিশেষ করিয়া লালনশাহী ফকিরদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনা হয় ও তাহারা তিনদিনব্যাপী গান ও নানা তত্ত্বালোচনা করে। এই সুযোগে ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত লালনশাহী ফকিরদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয় ও লালনের গান সম্বন্ধেও তাহাদের গান ও আবৃত্তি দ্বারা প্রকৃত পাঠ যাচাই করিয়া লই । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দ্বারা লালন ফকিরের খাতা হস্তগত হওয়ার গল্প ফকির-মহলে এতই প্রচলিত যে, ‘সাঁইজীর আসল খাতা‘য় এই গানগুলি কিরূপে আছে, তাহা না দেখিলে লালনের গানের সত্যকার রূপ সম্বন্ধে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া যাইতেছিল না ।
দেশ বিভাগের পর কলিকাতায় আসিয়া কোনো এক সূত্রে খবর পাই যে, রবীন্দ্রনাথের পুরানো কাগজপত্রের মধ্যে লালন কফিরের গানসংবলিত একখানা খাতা পাওয়া গিয়াছে । ঐ খাতা শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে আছে। তখন মনে হইল, ইহাই বোধহয় সেই বহু-শ্রুত, বহু-কথিত ‘সাঁইজীর আসল খাতা‘। সেই খাতা দেখিবার উদ্দেশ্যে আমি ১৯৪৯ সালে শান্তিনিকেতনে যাই । আমার সঙ্গে গিয়াছিলেন ‘সহজ মানুষ রবীন্দ্রনাথ’ ‘পল্লীর মানুষ রবীন্দ্রনাথ‘ ‘কবিতীর্থের পাঁচালি‘ প্রভৃতি গ্রন্থ-প্রণেতা শিলাইদহবাসী, পল্লী-গীতির অকৃত্রিম ভক্ত শচীন্দ্রনাথ অধিকারী মহাশয় । রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয়ের সৌজন্যে খাতাখানা হস্তগত হইলে দেখা গেল, ইহা সেই নানাপ্রকারের ভুলের নমুনা ভরা লালনের আখড়ার খাতাখানির একটি কপি । বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে দেখিলাম, ইহার মধ্যে লালনের অনেক সুপরিচিত গান নাই । বেশ বুঝা গেল, ‘আসল খাতা‘ সেই একমাত্র খাতা যাহার নকল রবীন্দ্রনাথ লইয়াছেন, যাহা মতিলাল দাশ মহাশয় দেখিয়াছিলেন এবং যাহা আমি কয়েকবার দেখিয়াছি । শচীন্দ্রবাবু বলিলেন এই হাতের লেখা তিনি ভালোরূপ চিনেন – ইহা শিলাইদহের ঠাকুর এষ্টেটের এক পুরাতন কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যের। শচীন্দ্রবাবু বহুদিন শিলাইদহের ঠাকুর এষ্টেটের কর্মচারী ছিলেন, সুতরাং তাঁহার কথা অবিশ্বাস্য নয়। অতএব মনে হয় যে, রবীন্দ্রনাথ লালনের আখড়া হইতে খাতাখানি সংগ্রহ করিয়া তাঁহার এক কর্মচারীকে দিয়া নকল করাইয়া লন, পরে উহা হইতে শুদ্ধ করিয়া কতকগুলি গান প্রবাসীতে প্রকাশ করেন। দীর্ঘদিন ধরিয়া রবীন্দ্রনাথের আসল খাতা লইয়া যাওয়ার যে গল্প চলিয়া আসিতেছিল, তাহার মূলে যে বিশেষ কিছু নাই, তাহা পূর্বে অনুমান করিলেও এবারে নিঃসন্দেহ হইলাম। অতঃপর লালনের পূর্ণাঙ্গ গানগুলি প্রকাশের আর কোনো বাধা রহিল না।
লালনের জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা যায় নাই। আমি কয়েক বছর চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তাঁহার সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য হিসাবে নিঃসংশয়ে কিছু
বলা যায় না।
তাঁহার সম্বন্ধে লোকমুখে যাহা শোনা যায় তাহা ঐ অঞ্চলের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যভা বিবেচনা করিয়া লালনের একটা সংক্ষিপ্ত জীবনী খাড়া করা গেল ।
পূর্বতন নদীয়া জেলার (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত কুমারখালী থানার অধীন কুষ্টিয়া হইতে চার-পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গোরাই নদীর তীরবর্তী ভাঁড়রা গ্রামে লালনের জন্ম হয়।
লালনের আবির্ভাব ও তিরোভাব-কাল সম্বন্ধে অনেকটা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। ১২৯৭ সালে কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া হইতে ‘হিতকরী‘ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ঐ হিতকরী পত্রিকাতে লালনের মৃত্যু সম্বন্ধে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঐ সংবাদটিতে আছে যে, লালন ১৭ই অক্টোবর শুক্রবার দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স ১১৬ বৎসর হইয়াছিল । হিতকরী পত্রিকার ঐ পুরানো অংশটুকু লালনের আখড়ায় রক্ষিত আছে। কিন্তু পত্রিকার তারিখের অংশটুকু নাই। অনুসন্ধিৎসু কোনো উপস্থিত ব্যক্তিকে ‘আখড়া‘র লোকজন ঐ অংশটুকু দেখায়। মতিলাল দাশ মহাশয়ও ঐ অংশটুকু দেখিয়াছিলেন। তাঁহার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে তিনি বলিয়াছেন, “হিতকরী”তে কোন তারিখ দেওয়া নাই, কাজেই কোন সালের কাগজ বোঝা গেল না। অন্যত্র হইতে পাওয়া যায় যে, লালন ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান— জন্মবর্ষ ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দ ।“ এই ‘অন্যত্র’ কোথায় ও তাহার কি সূত্র, তাহা তিনি উল্লেখ করেন নাই। ‘হিতকরী‘ পত্রিকা সম্বন্ধে বাংলার সাময়িকপত্রের ইতিহাস সংকলয়িতা ব্রজেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন,
রাজশাহীর ‘শিক্ষা-পরিচয়‘ লেখেন, ‘আমরা জানিয়াছি একজন সুপ্রসিদ্ধ দেশ-হিতৈষী “হিতকরী (পাক্ষিক) বৈশাখ, ১২৯৭, কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া হইতে প্রকাশিত । রাজশাহীর ‘শিক্ষা-পরিচয়’ লেখেন, – ‘আমরা জানিয়াছি একজন সুপ্রসিদ্ধ দেশ-হিতৈষী সাধারণের নিকট অদৃশ্য থাকিয়া ‘হিতকরী‘ পরিচালনা করিতেছেন।‘ আমাদের মনে হয়, পত্রিকাখানি মীর মশাররফ হোসেনের, এবং হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) অন্তরালে থাকিয়া উহার সহায়তা করিতেন । দ্বিতীয় বর্ষে ‘হিতকরী’ টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত হয়।” (বসুমতী, ভাদ্র, ১৩৫৮); (বাংলা সাময়িকপত্র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৮)।
‘হিতকরী‘ ১২৯৭ সালের বৈশাখ মাস হইতে প্রকাশিত হইয়া চৈত্র পর্যন্ত কুষ্টিয়াতে ছিল। তাহার পর-বৎসর মীর মশাররফ হোসেনের কর্মস্থল টাঙ্গাইলে উহা স্থানান্তরিত হয়। মীর মশাররফ হোসেন এবং কাঙ্গাল হরিনাথই কেবল এই পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালক ছিলেন তাহা নয়, কুষ্টিয়ার তৎকালীন কয়েকজন সাহিত্যামোদী ও বিদ্যোৎসাহী উকিলও এই পত্রিকার পরিচালনার ব্যাপারে অংশগ্রহণ ও অর্থসাহায্য কারিয়াছিলেন। লালনের মৃত্যুসংবাদসংবলিত অংশটুকু ঐ ১২৯৭ সালের ‘হিতকরী’রই অংশ তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ১২৯৭ সালের পঞ্জিকাদৃষ্টে দেখা যায় ১৭ই অক্টোবর ১লা কার্তিক শুক্রবার । ঐ অংশটুকু টাঙ্গাইল হতে প্রকাশিত ১২৯৮ সালের ‘হিতকরী’র অংশ হইতে পারে না, কারণ ১২৯৮ সালের ১৭ই অক্টোবর শনিবার দেখা যায়। সুতরাং লালনের মৃত্যুর তারিখ বাংলা ১২৯৭ সালের ১লা কার্তিক, ইংরেজী ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর । ঐ সংবাদে যে লালনের বয়স ১১৬ বৎসর বলা হইয়াছে, উহাই তাঁহার মৃত্যুকালীন ঠিক বয়স বলিয়া মনে হয়। জনশ্রুতি অনুসারে কেহ বলে লালনের বয়স দেড়শ, কেহ সোয়াশ, কেহ একশ-এর উপর; ঠিক বলিতে না পারিলও এটা বুঝা যায় যে, লালন বিশেষ দীর্ঘজীবী ছিলেন । লালনের মৃত্যুর সমসাময়িককালে প্রকাশিত স্থানীয় এক প্রত্রিকা কখনই বিশেষভাবে না জানিয়া নির্দিষ্ট একটা বয়সের উল্লেখ করিতে পারে না। সুতরাং লালন ১১৬ বৎসর বয়সেই মারা যান ইহা আমরা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করিতে পারি ।। তাহা হইলে তাঁহার জন্ম হয় বাংলা ১১৮১ সালে, ইংরেজী ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ।
লালন জাতিতে হিন্দু কায়স্থ ছিলেন। তাঁহার উপাধি ছিল কর, কেহ কেহ বলে দাস । আমি নিজে ভাঁড়রা গ্রামে গিয়া লালনের বাস্তুভিটার অনুসন্ধান করিয়াছি, কিন্তু অনুমান ও জনশ্রুতির উল্লেখ ব্যতীত কেহই সে সম্বন্ধে সঠিক কিছু বলিতে পারে নাই ।
শৈশব হইতেই লালন ধর্মভাবাপন্ন ছিলেন। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদির নানা উপাখ্যান সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করিয়াছিলেন। এখন একটি বিশেষ প্রশ্ন এই, লালন লেখাপড়া জানিতেন কিনা। এ সম্বন্ধে ঐ অঞ্চলের বহু লালনপন্থী ফকিরদের সঙ্গে আলোচনা করিয়াছি। তাহাদের অধিকাংশেরই মত লালন নিরক্ষর ছিলেন। তাহারা বলে, লালন লেখাপড়া জানিতেন না, তিনি মুখে মুখে গান রচনা করিয়া গাহিয়া যাইতেন, তাঁহার শিষ্যেরা পরে সেই গান লিখিয় রাখিত। ‘হিতকরী‘ পত্রিকাতেও ঐরূপ সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল। লালনের গানগুলির মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মশাস্ত্রের যে জ্ঞান, মতবাদের উপর যে অবিচলিত নিষ্ঠা, যে সত্যদৃষ্টি ও কবিত্ব-শক্তি প্রকাশ পাইয়াছে; তাহা দেখিলে লালনকে নিরক্ষর ভাবিতে মন কুণ্ঠিত হয় । নিজে তিনি গান লিখিয়া রাখিতেন না, ভাবের আবেশে গাহিয়া যাইতেন, তারপর শিষ্যেরা লিখিয়া রাখিত, তাহা হয়তো সম্ভব, কিন্তু তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন, এই সিদ্ধান্তের অনুকূলে কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নাই ।
তখনকার বাল্যবিবাহের যুগে অল্প বয়সেই লালনের বিবাহ হয় । প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দুদের অন্যতম বিখ্যাত তীর্থ শ্রীক্ষেত্রে যান। তখন পুরীধামে পায়ে হাঁটিয়া যাইতে হইত । গ্রামের প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিনি একত্রে রওয়ানা হইয়াছিলেন, পথের মধ্যে তিনি বসন্তরোগে আক্রান্ত হন। সহযাত্রীরা তাঁহাকে পথের মধ্যে রাখিয়া চলিয়া যায়। তখন সিরাজ নামে এক মুসলমান ফকির ও তাঁহার স্ত্রী লালনকে রোগযন্ত্রণায় অজ্ঞান অবস্থায় পথের উপর পড়িয়া থাকিতে দেখেন । তাঁহার দয়াপরবশ হইয়া লালনকে উঠাইয়া লইয়া সেবা-শুশ্রূষার দ্বারা তাঁহাকে নিরাময় করেন। ঐ রোগে লালনের একটি চক্ষু নষ্ট হইয়া যায়। ঐ ফকিরের কোনো সন্তানাদি ছিল না, তাঁহারা স্বামী-স্ত্রীতে লালনকেই পুত্ররূপে গ্রহণ করেন । লালন তাঁহাদের নিকট সন্তানবৎ প্রতিপালিত হইতে থাকেন এবং শেষে সিরাজের নিকট হইতে ফকিরি ধর্মে বা বাউল-ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
এই লালনগুরু সিরাজ সাঁই সম্বন্ধে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। মনসুরউদ্দীন সাহেব তাঁহার বন্ধুর বিবরণ অনুসারে বলেন যে, “সিরাজ সাঁই নদীয়া জেলার হরিনারায়ণপুর গ্রামস্থ এক পাল্কীবাহক।” (হারামণি, ভূমিকা, পৃ: ১/.) আমার বাড়ী ঐ হরিনারায়ণপুর গ্রামে । সেখানে লালনগুরু সিরাজ সাঁই বলিয়া কোনো পাল্কীবাহক ছিল, তাহা কোনো দিন শুনি নাই । ইহা যে নিছক বাজে গল্প তাহাতে সন্দেহ নাই ।
কুমারখালী-নিবাসী বৃদ্ধ শ্রীভোলানাথ মজুমদার মহাশয় ঐ অঞ্চলে সর্বপ্রথম লালনের গান সংগ্রহ করেন এবং লালনের সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধও দু‘একটি সভায় পাঠ করেন। লালন তাঁহার পিতার বন্ধু ছিলেন। তাঁহাদের বাড়ীতে ছেলেবেলায় তিনি লালনকে দেখিয়াছেন। তিনি বলেন, লালন-গুরু সিরাজ সাঁই-এর বাড়ী কুষ্টিয়া অঞ্চলে নয়। ফরিদপুর জেলার কালুখালী ষ্টেশনের নিকটে কোনো গ্রামে একসময়ে তাঁহার বাড়ী ছিল। কিন্তু তাঁহার কোনো স্থায়ী বাসস্থান ছিল না । তিনি প্রথম জীবন হইতেই সস্ত্রীক ভারতের নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। তিনি ছিলেন উচ্চাঙ্গের জ্ঞানী ও সাধক—প্রকৃত দরবেশ। মুসলমান হইলেও হিন্দুদের বহু তীর্থে তিনি ভ্রমণ করিয়াছিলেন। তিনিই ঐ অঞ্চলের সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিবর্জিত ফকিরি-ধর্মের অন্যতম আদি গুরু । এই প্রকৃত জ্ঞানী ও সাধক-গুরুর প্রভাব লালনের জীবনকে নূতনভাবে গঠিত করিয়াছিল।
সিরাজ সাঁই সম্বন্ধে ও সেইসঙ্গে লালনের সম্বন্ধে অন্য অঞ্চল হইতে আর একটি কথাও শোনা যায়। এই মতবাদের প্রধান প্রচারক পাঞ্জ শাহের সুযোগ্য পুত্র আমার অশেষ প্রীতিভাজন রফিউদ্দীন খোন্দকার সাহেব। তিনি আমাকে লিখিয়াছিলেন যে, সিরাজ যশোহর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার অন্তর্গত হরিশপুর গ্রামের একজন পাল্কীবাহক ছিলেন। লালনও ঐ গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। লালন অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণার বশবর্তী হইয়া গান রচনা করিতেন, কিন্তু তাঁহার তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করিতেন না। একদিন পাল্কীবাহক সিরাজ লালনকে তাঁহারই রচিত একটি গানের অর্থ ও ইঙ্গিত বুঝাইয়া দিতে বলেন, কিন্তু লালন তাহা সম্যকরূপে পারেন না। তখন সিরাজ তাহার প্রকৃত অর্থ বলিয়া দিয়া লালনকে বিস্মিত করেন। সেই অবিধি লালন সিরাজকে গুরুপদে বরণ করিয়া তাঁহারই নির্দেশে সাধন-ভজন করেন এবং শেষে কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী সেঁউড়িয়াতে গিয়া আখড়া স্থাপন করিয়া বাস করেন।
নানা কারণে এই বিবরণটি মোটেই বিশ্বাসযোগ নয়। তবে হরিশপুর যে একসময় সমগ্র মধ্যবঙ্গের মধ্যে এই মতাবলম্বী ফকিরদের একটা প্রধান আড্ডা ছিল এবং এই মতের অনেক হিন্দু সাধকও সেখানে বাস করিত এবং সম্মিলিতভাবে একই তত্ত্বালোচনা ও ধর্মসাধনা করিত এবং লালনের অনেক শিষ্যও এখানে বাস করিত, তাহার অনেক প্রমাণ আছে। লালনের পরে বিখ্যাত ফকির পাঞ্জ শাহও এই হরিশপুরেই বাস করেন এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত এই মতাবলম্বী বহু মুসলমান ফরিকরের আস্তানা এই গ্রামে বর্তমান দেখিয়াছি। সুতরাং লালনের বাস, এমন কি লালন-গুরু সিরাজ সাঁই- এর বাস এখানে কল্পনা করা অস্বাভাধিক নয়।
এদিকে গ্রামবাসীরা বাড়ী ফিরিয়া লালনের মৃত্যুসংবাদ রটাইয়া দেয়। পিতা-মাতা, পত্মী ও আত্মীয়স্বজন সকলেই শোকসন্তপ্ত হইলে। তারপর কয়েক বৎসর পরে একদিন লালন বাড়ী আসিয়া উপস্থিত । তিনি তাঁহার নিদারুণ অসুখের কথা, মুসলমান ফকিরের নিকট অবস্থান ও তাঁহার অন্নজল গ্রহণের কথা অকপটে সকলের নিকট ব্যক্ত করেন। তখন রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুসমাজ লালনকে গ্রহণ করিতে অস্বীকার করে । লালন বলেন যে, তিনি সংসার করিতে আসেন নাই, তাঁহার স্ত্রীর নিকট জানিতে চাহেন যে, সে তাঁহার সঙ্গে যাইবে কিনা। তাঁহার স্ত্রী স্বামীর সহিত যাইতে অস্বীকার করেন। তখন লালন একেবারে সংসারের মায়া কাটাইয়া সিরাজ সাঁই-এর সহিত পুনর্মিলিত হন । গুরুর নিকট অবস্থানকালে তিনি নানা ধর্মের সমস্ত তথ্য অবগত হন এবং গুরুর উপদেশ অনুসারে সাধন-ভজনে প্রবৃত্ত থাকেন ।
গুরুর সহিত নানাস্থানে ভ্রমণের পর সম্ভবত গুরুর মৃত্যু হইলে তিনি আনুমানিক ১২৩০ সালে কুষ্টিয়ার প্রান্তে গোরাই নদীর ধারে সেঁউড়িয়া নামক পল্লীতে আসিয়া উপস্থিত হন। দেশের প্রতি একটা স্বাভাবিক টানের জন্যই হোক, বা অন্য কারণেই হোক, লালন এই স্থানে একটা স্থায়ী আস্তানা গাড়েন ।
ঐ স্থানে বহু মুসলমান তন্তুবায় – ‘জোলা‘দের বাস ছিল। এখনও ওখানে অনেক ঘর মুসলমান বয়নশিল্পীর বাস। ঐ স্থানের এক মসলমান জোলা-রমণীকে লালন নিকা করিয়া তাঁহারই বাড়ীতে বাস করেন। সেই স্থানই ক্রমে তাঁহার আখড়ায় পরিণত হয়।
আমার মনে হয়, এই স্থানের বয়নব্যবসায়ী কোনো মুসলমান তাহাকে এ স্থানে লইয়া আসেন। প্রথম প্রথম লালন তাঁহারই বাড়ীতে ছিলেন, তারপর ঐ শ্রেণীর এক রমণীকে নিকা করিয়া তাঁহারই বাড়ীতে গিয়া বাস করেন ।
কুষ্টিয়ায় দেখিয়াছি, লালনের আখড়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষকগণ এই কারিকর বা জোলা শ্রেণীর মুসলমান । তাঁহাদের অনেকেই বর্তমানে শিক্ষিত ও অর্থশালী। তাঁহারা আখড়ার উৎসবাদিতে অর্থ সাহায্য করেন। এই ‘মোমিন‘ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে লালন সম্প্রদায়ের কিছু প্রভাব আছে। যদিও শরীয়তবাদী মুসলমানদের নিন্দায় তাঁহারা একেবারে প্রকাশ্যভাবে কিছু করিতে পারেন না, তবুও তলে তলে তাঁহারা নানাভাবে লালনের স্মৃতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করেন। এই শ্রেণীর কয়েকজন স্থানীয় মুসলমান ভদ্রলোকের সহিত আমার এ বিষয়ে আলাপ হইয়াছিল। তাঁহাদেরও মত এই যে, লালনকে এ দেশে আনিবার বিষয়ে ও তাঁহাকে প্রথম অবস্থায় এখানে প্রতিষ্ঠিত করিবার বিষয়ে এই বয়নব্যবসায়ী মুসলমানগণই অগ্রণী ছিল ।
লালন প্রথম প্রথম সেঁউড়িয়ায় খুব কম থাকিতেন। চতুষ্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে – পাবনা, রাজশাহী, যশোহর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় –শিষ্যগণের সহিত ঘুরিয়া বেড়াইতেন ও তাঁহার মতবাদ প্রচার করিতেন। সেই সময় বহুলোক তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাহার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশী। অল্পসংখ্যক হিন্দুসমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকও তাঁহার শিষ্য হইয়াছিল। একসময় এই মধ্যবঙ্গে এই ‘নেড়ার ফকীর‘দের সংখ্যা খুব বেশী ছিল ।
৪০/৫০ বৎসর পূর্বেও এই অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে শতকরা ১০ জন এই মতাবলম্বী ছিল। লালনের সমসাময়িক বা পরবর্তীকালে এই মতের দু‘চারজন গুরুর উদ্ভব হইয়াছিল বটে, কিন্তু লালনই ছিলেন এ অঞ্চলে এই মতবাদের একজন শক্তিশালী আদিগুরু ও প্রচারক। শরীয়তবাদীদের অত্যাচারে এই নেড়ার বা বে-শরা বা মারফতী ফকিরদের সংখ্যা ক্রমেই কমিয়া গিয়া বিলুপ্তির সীমানায় আসিয়া পৌছিয়াছে। বর্তমানে পাকিস্তানের আমলে ঐ সব অঞ্চলে বোধহয় তাহাদের আর চিহ্নমাত্র নাই ।
মনসুরউদ্দীন সাহেব তাঁহার বিবরণীতে লিখিয়াছেন, – “তিনি (লালন) স্বেচ্ছায়
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।”
লালনের ধর্ম কি ইসলাম ধর্ম? লালন-গুরু সিরাজ সাঁই জাতিতে মুসলমান হইলেও ধর্মে কি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন? তাঁহাদের ধর্ম ফকিরি ধর্ম–আউল-বাউলের ধর্ম-
জাতি-ধর্ম-সংস্কারনির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট সাধনমার্গের ধর্ম ।
মনসুরউদ্দীন সাহেব কি ফকিরদের গানই কেবল সংগ্রহ করিয়াছেন, গানের ভিতরে প্রবশে করেন নাই? আশ্চর্যের বিষয়, লালনের গানে যে ধর্মমত ব্যক্ত হইয়াছে, তাহাকে কি করিয়া অধ্যাপক সাহেব ইসলাম ধর্ম বলিয়াছেন? কোরানের দুই চারিটি বয়েৎ বা কয়েকটি আরবী বা ফারশী শব্দ দেখিয়াই কি অধ্যাপক সাহেব ঐরূপ অনুমান করিয়াছেন?
লালন জাতিতে জাতিতে ও ধর্মে ধর্মে কোন পার্থক্য দেখেন নাই, হিন্দু ও মুসলমান ধর্মে কোন বিভেদ বোঝেন নাই। আল্লাকে ‘অধরকালা‘ এবং মহম্মদ ও চৈতন্যদেব উভয়কেই সমানভাবে ঐশীশক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত মানবশ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করিয়াছেন। তাঁহারাই মানুষের উদ্ধারের জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হইয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যেই ভগবানের পূর্ণ-প্রকাশ হইয়াছে। সুফী পারিভাষিক শব্দের তাঁহারাই ‘অল-ইনসানু’ল- কালেম‘ – দেবমানব – The Perfect Man. তাঁহারাই মানবের প্রকৃত সদ্গুরু— পথপ্রদর্শক । এই সদ্গুরুর কৃপা না হইলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা যায় না, তাই লালন তাঁহাদের উভয়েরই কৃপাভিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার সম্প্রদায়ের সাধনতত্ত্ব হিসাবে তিনি গোপীকৃষ্ণের যুগল-প্রেমকে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়াছেন এবং সেই প্রেমের মহিমা অনেক গানে কীর্তন করিয়াছেন । এ সব কি তাঁহার ইসলাম ধর্মমতের পরিচায়ক?
শরীয়তবাদী মুসলমানগণ লালনকে ভালো চোখে কোনদিনই দেখেন নাই। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল লালনের খ্যাতি-প্রতিপত্তির দিনেও তাঁহাকে নিন্দা করিয়াছে। ‘হিতকরী‘ পত্রিকায় লালনের যে মৃত্যুসংবাদ এবং তাঁহার সম্বন্ধে যে বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে আছে যে, সাধুসেবা নাম লালনের শিষ্য ও তাঁহার সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাভিচার চলে, এবং অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয়-সেবায় রত থাকে বলিয়া লালনের শিষ্যদের সন্তানাদি হয় না। ইহাই ইসলাম-ধর্মাবলম্বীদের লালন ও তাঁহার সম্প্রদায়ের প্রতি ধারণা। এই বাউলপন্থী নেড়ার ফকীরেরা চিরকাল ইসলাম-ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়াছে।
মৃত্যুর ১৫/২০ বৎসর পূর্বে লালন দেশভ্রমণ হইতে ক্ষান্ত হন। যদিও তাঁহার স্বাস্থ্য অতি উত্তম ছিল, তবুও বার্ধক্যবশত পূর্বের মতো অনায়াসে চলাফেরা করিতে পারিতেন না। তাঁহার একটা ছোটো ঘোড়া ছিল । তাহাতে চড়িয়া প্রয়োজন হইলে তিনি পার্শ্ববর্তী নানাস্থানে যাইতেন। তখন তিনি পার্শ্ববর্তী পাঁচ-ছয়টি জেলার মধ্যে বহুসংখ্যক শিষ্যের গুরু; জ্ঞানী, তত্ত্বদর্শী ও সাধক হিসাবে তাঁহার যথেষ্ট যশ ও প্রতিপত্তি এবং তাঁহার গান লোকের মুখে মুখে ।
লালনের চেহারা সম্বন্ধে ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত গায়ক লালনপন্থী ফকীর খোদাবক্স শাহ বলেন (১৯৪০ সালে বয়স ৯৭ বৎসর) যে, লালনের মাথায় বাবরী চুল ছিল, মুখে ছিল লম্বা দাড়ি, একটি চক্ষু দৃষ্টিহীন, মুখে অল্প বসন্তের দাগ, আয়ত চক্ষে এক গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। ভোলানাথ মজুমদার মহাশয়ও লালনের ঐরূপ বর্ণনা দেন। তিনি ছেলেবেলায় তাঁহাদের বাড়ীতে লালনকে কয়েকবার দেখিয়াছেন।