ফ কি র লা ল ন শা হ – বসন্তকুমার পাল

শৈশব হইতেই দেখিতে পাই, এক সম্প্রদায়ের ফকিরগণ সারঙ্গ কিম্বা গোপীযন্ত্র বাজাইয়া হিন্দু বৈরাগীদের ন্যায় গান গাহিয়া ভিক্ষা করিতে আসে । কৌতূহলবশে আমার পিতামহের নিকট একদিন ইঁহাদের বিষয় জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম, ইঁহারা সাঁইজীর শিষ্য বা বালক এবং তিনি সাঁইজীর জীবনকথাও সংক্ষেপে বলিলেন। তখন আমি শিশু, সাঁইজীর জীবনের করুণ কাহিনী যাহা শুনিলাম উহা বিশদরূপে জানিবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার অন্তঃকরণে জাগরুক হইয়া রহিল। সাঁইজী যে কে, বৰ্ত্তমান প্রবন্ধ পাঠককে তাহারই কিঞ্চিৎ আভাস দিব।

সাঁইজী যখন লোকলীলা সম্বরণ করেন সেই সময় কুষ্টিয়া হইতে “হিতকরী” নামে প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে “মহাত্মা লালন ফকীর” নামক প্রবন্ধ পাঠে জানা যায় তিনি ইংরাজী ১৮৯০ খৃষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর শুক্রবার ভোর পাঁচটার সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফকিরেরা বলেন উহা “গার্শির দিন” অর্থাৎ কার্ত্তিক মাসের প্রত্যূষা, বাঙ্গালা ১২৯৭ সাল। উক্ত পত্রিকার মতে মৃত্যুকালে তাঁহার বয়ঃক্রম ১১৬ বৎসর হইয়াছিল । সুতরাং তাঁহার জন্ম ইংরাজী ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে। শৈশবে তাঁহার সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনী শুনিয়া বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়া প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করি । ইহার জন্য প্রথম আলোক পাই তদানীন্তন ফকির ওয়াছিমউদ্দিন সাহেবের নিকট হইতে। তাহার পর সাঁইজীর সহিত যাঁহাদের চাক্ষুষ পরিচয় ছিল এবং একত্রে ও প্রতিবাসী হিসাবে যাঁহারা তাঁহার সহিত বসবাস করিয়াছেন এইরূপ ব্যক্তিবর্গের অভিজ্ঞতালব্ধ বিবৃতি লইয়া এই প্রবন্ধ আরম্ভ করি।

কুষ্টিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন হইতে প্রায় এক মাইল পূৰ্ব্বদিকে সেঁউড়িয়া নামক পল্লীতে সাঁইজীর আখড়া, সাঁইজীর শিষ্যগণ এই স্থানেই বাস করিতেছেন। এই আখড়াতেই বঙ্গের “সমাজহারা” সাঁইজী সমাধিস্থ হইয়া শান্তি শয়নে অবস্থান করিতেছেন। তাঁহার শিষ্য ভোলাই সাহ ও পাঁচু সাহের নিকট শুনিলাম হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে সাঁইজীর বিষয় যাহা লেখা হইয়াছিল উহা সর্ব্বৈব সত্য।

যে স্থানেআমার বাড়ী তাহার অপর পাড়া অর্থাৎ ভাঁড়রা বা ভাণ্ডারিয়া গ্রামে যে স্থানে সম্প্রতি দুঃখী সেখ চৌকিদার বাড়ী করিয়া আছে, ঠিক এই স্থানেই সাঁইজীর জননী শেষজীবন অতিবাহিত করিয়া যান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তাঁহার পূর্ব্বপুরুষের বিষয় ঠিক ঠিক বলিতে সক্ষম এমন কেহ আর এখন জীবিত নাই । তবে সাঁইজী এই গ্রামেরই লোক ইহা প্রাচীন অধিবাসীদিগের প্রায় সকলেই জানা আছে। এই স্থানে সাঁইজীর বিশেষ কোন পরিচয় গ্রহণ করিতে না পারায় সেঁউড়িয়া আখড়ায় যাই। তথায় তাঁহার শিষ্য পাঁচু শাহ, ভোলাই শাহ ও ভাঙ্গুড়ী ফকিরাণীর সহিত সাক্ষাৎ করি। পাঁচু শাহ বৃদ্ধ, তাঁহার বয়ঃক্রম তখন (১৩২৯ সালে) ৯৯ বৎসর। সাঁইজীর জীবনী ও সাধনা প্রসঙ্গে আলোচনার কথা শুনিয়া তাঁহারা খুব আনন্দের সহিত আমাকে সম্বৰ্দ্ধনা করেন। বর্তমানে তাঁহাদের কেহই আর ইহজগতে নাই। পরবর্তী সময়ে দয়াল সাহ ও কুধু সাহও এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করেন। সাঁইজীর বিষয় যাহা কিছু সংগ্রহ করিয়াছি তাহার সূচনা তাঁহাদের বাচনিক তথ্য এবং প্রদত্ত সঙ্গীত হইতে ।

সাঁইজী কায়স্থ কুলে চাপড়ায় বিখ্যাত কর মহাশয়দের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই চাপড়া কুষ্টিয়া মহকুমায় গৌরীনদীর তীরে অবস্থিত। তাঁহার পিতার নাম মাধব কর। শৈশবেই তাঁহার পিতৃবিয়োগ ঘটে। ‘মহাত্মা লালন ফকিরপুস্তক লিখিবার সময় সাঁইজীর পিতার নাম জানিতে পারি নাই। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে শ্রদ্ধেয় তারাপদ শাস্ত্রী মহাশয় ও চাপড়ার কতিপয় ব্যক্তির নিকট জানিতে পারি তাঁহার পিতার নাম মাধব কর। সম্প্রতি প্রকাশিত আমার “তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব” গ্রন্থে লালনের পিতার নাম উল্লেখ করিয়াছি। এ সম্পর্কে বর্ত্তমান স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক শ্রীমান আবুল আহসান চৌধুরীকেও চিঠিপত্র ও সাক্ষাতে সবকিছু জানাইয়াছি। বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া যতদূর জানিতে পারিয়াছি তাহাতে মনে হয় সাঁইজী আত্মীয়দিগের সহিত পৃথক হইয়া ভৌমিক মহাশয়দিগের বাটীর সন্নিহিত দাসপাড়া নামক বস্তিতে বাস করেন। ইহা ভাঁড়রার মধ্যে; চাপড়ার সীমান্তে । দার পরিগ্রহ করিবার পর তাঁহার বিধবা জননী সমভিব্যহারে এই স্থানে বাস করেন ।

সাঁইজীর মাতামহের নাম ভস্মদাস। তাঁহার দুই পুত্র ও তিন কন্যা। পুত্রদ্বয়ের নাম কৃষ্ণদাস ও রাজুদাস (রাজেন্দ্র হইতে অপভ্রংশ রাজু)। কন্যাত্রয়ের নাম রাধামণি, নারায়ণী ও পদ্মাবতী । রাধামণির বংশ নির্মূল প্রায়, তাঁহার একমাত্র বিধবা পৌত্রীই শেষ বংশধর। ইহারই বাচনিক সাঁইজীর বংশ পরিচয় অবগত হইয়াছি। নারায়ণীর বংশও প্রায় এইরূপ, তাঁহার দত্তক প্রপৌত্র শ্রীযুক্ত অনন্তলাল ভৌমিকই জলপিণ্ডের একমাত্র অধিকারী— (এই প্রবন্ধ লিখিবার পর তিনিও ইহলোক হইতে বিদায় হইয়াছেন)। পদ্মাবতীর একমাত্র তনয়ই এই প্রবন্ধের বর্ণিত মহাপুরুষ।

ভৌমিক মহাশয়দিগের বাড়ী গিয়া জানিতে পারিলাম সাঁইজী জীবিত অবস্থায় সমাজ প্রত্যাখ্যাত হইবার পর কখনও তাহাদের বাড়ীতে পদার্পণ করেন নাই । তবে ভৌমিক মহাশয়েরাই সময় সময় তাঁহার আখড়া সেঁউড়িয়া গিয়া সদালাপ শ্রবণ করিতেন। সাঁইজীর শিষ্যেরা বলেন ভৌমিক মহাশয়েরা আসিলে যত্নসহকারে তাঁহাদের আহারাদির ব্যবস্থা করা হইতে । তাঁহারা আখড়ায় আসিয়া স্বহস্তে রন্ধনাদি করিয়া খাইতেন । সাঁইজী যে স্বর্গীয় আনন্দচন্দ্র ভৌমিক মহাশয়ের মাসতুত ভাই এবং ভাঁড়ারা গ্রামের অধিবাসী ইহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। ভাঙ্গুরী ফকিরানী বলিয়াছেন গৌরীনদী পার হইবার সময় ভাঁড়ারা ঘাটে খেওয়া নৌকায় বসিয়া সাঁইজী একদিন ভৌমিক মহাশয়ের সহিত তাঁহার পরিচয়ের কথা বলেন ।

সাঁইজীর বাল্যনাম লালন কর। তিনি যে পাড়ায় বাস করিতেন তাহা অদ্যাপি দাসপাড়া নামে খ্যাত। ইহা ভৌমিক মহাশয়দিগের বাটীর অতি নিকট। দুঃখ ও আশ্চর্য্যের বিষয় এই দাসপাড়ায় কতকগুলি পুরাতন পতিত বাস্তুভিটা, প্ৰকাণ্ড বিটপীবল্লরী ও বিস্তীর্ণ গুল্মকান্তার ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। শুনিলাম এখন নাকি তাহাও নদীগর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছে। সে দাসবংশ এখন বিলুপ্ত। সাঁইজী এই দাস বংশের বাউল দাস নামক কোন প্রতিবাসীর সহিত মুর্শিদাবাদ জিলায় বহরমপুরের নিকট গঙ্গাস্নানে যাত্রা করেন। তখন রেল ছিল না। তীর্থযাত্রীরা নৌকাযোগে যাতায়াত করিতেন। সঙ্গীদের সহ গঙ্গাস্নান সমাপন করিয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনকালে লালন বসন্তরোগে গুরুতর আক্রান্ত হন। রোগের আক্রমণ এতই বৃদ্ধি পায় যে ক্রমে তাঁহার সংজ্ঞা লোপ হয় এবং দুরন্ত ব্যাধির প্রচণ্ড প্রকোপে তিনি মৃতবৎ অসাড় হইয়া পড়েন ৷ সঙ্গীগণ তাঁহাকে মৃত মনে করিয়া যথাবিহিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপনান্তে মুখাগ্নি করিয়া গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। লালনের হিন্দুজীবনের বিদায় পালার এক অঙ্ক এইখানেই শেষ হইল । যে সকল গুণধর সহযাত্রী “মৃত” লালনের মুখাগ্নি ক্রিয়া নিষ্পন্ন করিয়া গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাঁহারা গ্রামে ফিরিয়া তীর্থ পরিভ্রমণে ভাগ্যবান লালনের গঙ্গাপ্রাপ্তির সৌভাগ্যের কথা তদীয় জননী ও সহধর্মিণীর নিকট সুললিত ভাষায় বর্ণনা করিয়া ও আপন আপন দায়িত্ব হইতে অব্যাহিত লাভ করিয়া পৈতৃক প্রাণ লইয়া ঘরে উঠিলেন ।

লীলাময়ের ইচ্ছায় পতিতোদ্ধারিণীর স্নিগ্ধ লহরে অন্ত্যেষ্টিকৃত লালনের অন্তঃসংজ্ঞাশীল দেহ তীরে উঠিয়া পড়ে, এইসময় তাহার কণ্ঠ হইতে অস্ফুটস্বর উত্থিত হয় । কোনো দয়াবতী মুসলমান রমণী তখন নদীতে জল লইতে আসিয়া এই মুদ্র কণ্ঠস্বর শুনিতে পান এবং দূরে ছুটিয়া গিয়া গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত শবটিকে দর্শন করিয়া জানিতে পারেন তাহাতে প্রাণবায়ু তখনো বহমান । স্নেহপ্রবণ রমণী-হৃদয় এই নিদারুণ দৃশ্যে গলিয়া গেল । তিনি এই মৃতমন্য মানব বপুটিকে টানিয়া তুলিলেন এবং স্বগৃহে প্রত্যাগমন করিয়া স্বকীয় পরিজনবর্গের নিকট এই আশ্চর্য্য শবের বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করেন। কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া সকলেই নদীতীরে আসেন এবং মমতা-বিগলিত হইয়া এই জীবস্মৃত ব্যক্তিকে বাড়ী লইয়া যান ।

এই মুসলমান রমণী তন্তুবায় (বা জোলা) জাতীয়া। আমার মনে হয় তিনি সামান্য রমণী নহেন, মাতৃরূপিণী মূর্তিমতী করুণা। ভীষণ পীড়ায় জীবনে হতাশ, তীর্থবন্ধু কর্তৃক অপরিচিত এবং জনশূন্য সৈকত পরিত্যক্ত লালন যখন প্রাণ খুলিয়া অকূলের কাণ্ডারীকে আশ্রয় লাভের জন্য ডাকিতে লাগিলেন তখন সেই নিরাশ্রয়ের আশ্রয় যেন নারীরূপ পরিগ্রহ করিয়া বিজন বেলায় তাঁহাকে আপন অভয় অঙ্কে স্থান দিতে ছুটিয়া আসিলেন। বসন্ত অতি সংক্রামক রোগ, সুতরাং জননী রোগীকে লইয়া তাঁতঘরে রাখিয়া দিলেন এবং আপন সন্তানজ্ঞানে যত্ন শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। তাঁহার আন্তরিক শুশ্রূষায় রোগীর অবস্থা ক্রমে পরিবর্ত্তিত হইতে লাগিল। ইতিপূর্ব্বে পাড়ার সকলেই লালনের জীবনরক্ষা বিষয়ে সম্পূর্ণ হতাশ হইয়াছিলেন; কিন্তু যখন দিনের পর দিন অতীত হইতে লাগিল, রোগী একভাবেই রহিল তখন সকলেই আগ্রহ-সহকারে সংবাদ রাখিতে লাগিলেন। অবশেষে লালন সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিল । তাঁহার আশ্রয়দাত্রীর প্রাণের প্রচ্ছন্ন মমতার সজীব মূর্ত্তি মেঘমুক্ত সূর্যের ন্যায় লোকচক্ষে উদ্ভাসিত হইল । সুস্থ হইবার পর লালন তাঁহার জীবনদাত্রী জননীর নিকট স্বীয় পরিচয় ও তীর্থ পর্যটনের আনুপূর্বিক অবস্থা যথাযথ বিবৃতি করিলেন। অনন্তর সবল হইয়া পদব্রজে আপন গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন। যে সমস্ত গুণধর সহযাত্রী মৃত লালনের মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহারাই গ্রামে আসিয়া তীর্থস্থানে ভাগ্যবান লালনের গঙ্গাপ্রাপ্তির সৌভাগ্যের কথা তদীয় জননী ও সহধর্মিনীর নিকট সুললিত ভাষায় প্রকাশ করিয়া আপন আপন দায়িত্ব হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে তীর্থ করিয়া লালন ঘরে ফিরিতেছে, লালনের স্ত্রী ও জননী কত আশায় দিনের পর দিন গনিয়া পথ চাহিয়া আছেন, হায়! অদৃষ্টের নিদারুণ পরিহাস এই মর্মান্তিক সংবাদ যখন তাঁহাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল, তাঁহারা অন্তরের অব্যক্ত যন্ত্রণায় পাষাণে মাথা ভাগিতে লাগিলেন। কিন্তু বিধিলিপির উপর হস্তক্ষেপ করে কে? যাহা হউক সঙ্গীদিগের কথামত নির্দিষ্ট দিবসে লালনের শ্রাদ্ধাদি পারলৌলিক ক্রিয়া যথাবিধি সম্পন্ন করিয়া তাঁহার স্ত্রী বৈধব্যাচার পালন করিতে আরম্ভ করিলেন।

সংসারে পদ্মাবতীর আর এমন কেহই অন্তরঙ্গ নাই, একমাত্র বিধবা পুত্রবধূ, অতি কষ্টে তাঁহার দিনপাত হইতেছে । এই সময়ে সহসা একদিন অপরাহ্নে কোনো অপরিচিত যুবক পদ্মাবতীর দ্বার-দেশে আসিয়া পরিচিত কন্ঠে “মা” বলিয়া ডাকিয়া দাঁড়াইল। পদ্মাবতী স্বপ্নচকিতের ন্যায় শিহরিয়া উঠিলেন, তাঁহার প্রাণের সমুদ্র অনন্ত লহরীতে গৰ্জ্জাইয়া উঠিল; মমতাময়ী জননীর প্রাণ মুহূর্ত মধ্যে আপন সন্তানকে চিনিয়া ফেলিল। পুত্র বসন্ত রোগে মারা গিয়াছে, জ্ঞাতিগণ তাহার মুখাগ্নি-ক্রিয়া পর্য্যন্ত সম্পন্ন করিয়া আসিয়াছেন, তাহার পর তাঁহার শ্রাদ্ধাদিও যথারীতি নিষ্পন্ন হইয়াছে, তাঁহার স্ত্রী এখন বৈধব্যাচার পালন করিয়া কঠোরভাবে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছেন এখন সেই স্বর্গবাসী লালন কেমন করিয়া পুনরায় মানব-মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া পদ্মাবতীর কুটীর- সমগত হইল! কিন্তু একদিকে বসন্তের প্রকোপে মুখশ্রী কিঞ্চিৎ বিকৃত অন্যদিকে আবার মুখাগ্নি সলিতার ক্ষত-চিহ্নও ওষ্ঠ-প্রান্তে জাজ্বল্যমান পরিস্ফুট; একদিকে তীৰ্থ-প্ৰত্যাগত জ্ঞাতিগণের প্রদত্ত বিবরণ অন্যদিকে নবাগত লালনের মুখশ্রী— এই সকল একত্র সমাবেশ করিয়া দেখিলে এই প্রহেলিকা মুক্ত যুবককে প্রকৃত লালন বলিয়া সন্দেহ করিতে কেহই সাহস করিবে না। লালনের স্ত্রী ও পদ্মাবতী উভয়েই তাঁহাদের সম্বলকে চিনিয়া ফেলিলেন।

পদ্মাবতী আপন বুকের সংশয় বুকে লুকাইয়া পরলোক হইতে পুনরাগত পুত্রকে বসিতে দিলেন। ক্রমে সমস্ত বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক শ্রবণ করিলেন। তাহার প্রাণে উল্লাস- লহরী রঙ্গে রঙ্গে নৃত্য করিতেছে, কিন্তু তাহা আর কেহ জানিতে পারিতেছে না । ইহার পর যখন শুনিলেন পুত্র মুসলমানের অন্ন গ্রহণ করিয়াছে তখন তাঁহার প্রাণের উদীয়মান হর্ষ সুধাকর ক্রমে বিষাদে-বারিতে সমাচ্ছন্ন হইতে আরম্ভ হইল । রাত্রি আসিল । পদ্মাবতী পুত্রকে ভোজন করিতে দিলেন, কিন্তু থালার পরিবর্তে কদলীপত্রে এবং রন্ধনশালার পরিবর্তে শয়ন-গৃহের বারান্দায়। লালন এই পরিবর্তনের কথা জননীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু বিশেষ কোনো উত্তর পাইলেন না ।

পরদিন প্রাতে পদ্মাবতীর গৃহ লোকে লোকারণ্য হইল । রাত্রি মধ্যেই সর্ব্বত্র সংবাদ প্রচারিত হইয়াছে যে, লালন কর যমপুরী হইতে লোকালয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে । বসন্তের চিহ্নে লালনের মুখশ্রী কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হইয়াছে, তথাপি সম্মুখে আসিলে সকলেই স্পষ্টরূপে লালনকে চিনিতে পারিল এবং লালনও গ্রামের সকলকেই চিনিয়া ফেলিল। এখন কথা হইল লালনের সম্বন্ধে সমাজ কি ব্যবস্থা করিবে। সে যে মুসলমানের অন্নে জীবন রক্ষা করিয়াছে, তাহা নিজ মুখেই কৃতজ্ঞতা-গদগদ চিত্তে প্রকাশ করিতেছে। তাহার পর মুখাগ্নি-ক্রিয়া শেষ করিয়া তাহাকে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করা হইয়াছিল এবং তখন তাহার পারলৌকিক ক্রিয়াদিও যথারীতি সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। এই সকল কথা লইয়া লোক-সমাজে খুব গুরুতর আলোচনা ও সমালোচনা চলিতে লাগিল । লালন যখন গ্রামের আবালবৃদ্ধবণিতার নাম ধরিয়া চিনিয়া ফেলিল, তখন তাহাকে প্রকৃত লালন বলিয়া স্বীকার করাতে কাহারও আপত্তি রহিল না, তাহার পূর্ব্বোক্ত কারণগুলি বিদ্যমান থাকায় তাহাকে সমাজে গ্রহণ করার ঘোর আপত্তি উঠিয়া পড়িল। কেহ বলিল, যবনান্নভোজীকে সমাজে আদৌ গ্রহণ করা যায় না; আবার কেহ কেহ “মিষ্টান্নম ইতরে জনাঃ”র ব্যবস্থা দিতে লাগিলেন। দুঃখিনী পদ্মাবতী নিরূপায়, তাঁহার এমন সঙ্গতি নাই যে, রসনা-তৃপ্তিকর অন্নব্যঞ্জনাদি দ্বারা সমাজকে পরিতৃপ্ত করাইয়া পুত্রকে ঘরে লইবার জন্য তখনই অনুমতি লইতে পারেন। ইহার পর যখন তাঁহার শ্রাদ্ধাদিও হইয়া গিয়াছে তখন সে সম্বন্ধে প্রায়শ্চিত্তাদিই বা কি দিয়া করিবেন । এই সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা করিতে হইলে কেবলই অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এখন তিনি পথের ভিখারিণী; সুতরাং এই সকল সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাঁহার সন্তানকে আপন মায়ের ঘরে পরের ছেলের মতন বাস করিতে হইবে। পদ্মাবতী প্রাণের বেদনায় উন্নাদিনী। প্রথম দিনের মতন আজও তিনি আপন হারানিধিকে কদলী-পত্রে করিয়া ভোজন করিতে দিলেন।

আপন বাড়ীতে আপন জননীর হস্তে লালনের এই শেষ অন্নগ্রহণ। যিনি হীন পতিতকে আপন অন্তরঙ্গ জ্ঞানে উপযুক্ত শিক্ষা দ্বারা উচ্চে স্থাপন করিবেন, যিনি সমগ্র বঙ্গদেশে এক অভিনব পবিত্রতার বিমল ধারা ঢালিয়া দিবেন, তাঁহার পক্ষে কি সামান্য গণ্ডীর মধ্যে অপবিত্র হইয়া পড়িয়া থাকা সম্ভব । যেখানে আপন জননী একমাত্র সন্তানকে বুকে করিয়া রাখিতে অক্ষম, এমন সংকীর্ণ ও অভিশপ্ত সমাজে লালনের মত উদার, মহৎ এবং উন্নতমনার অবস্থান করা কি কখনো সম্ভবপর হয়? এই সময় যশোহর জিলায় ফুলবাড়ী গ্রামে সিরাজ সাঁই নামক জনৈক দরবেশ বাস করিতেন। লালন যখন তাঁহার জীবনদাত্রী জননীর বস্ত্রবয়ন-গৃহে শায়িত, ঘটনাক্রমে সেই সময় এই দরবেশও পর্যটন করিতে করিতে এই গ্রামে আসিয়া লালনের বৃত্তান্ত শুনিতে পান এবং অচিরে তাঁহার রোগশয্যার পার্শ্বে আসিয়া সমাসীন হন। লালন যখন কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন তখন হইতেই সিরাজ সাঁই তাঁহাকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। সিরাজের প্রাণস্পর্শী উপদেশে লালনের হৃদয় এক অভিনব ভাবের আবেশে আবিষ্ট হইয়া পড়ে। এই উপদেশরাশি তাঁহার যাতনাক্লিষ্ট প্রাণে এক নব পর্যায় আনিয়া দেয়। ইহার পর গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া সমাজের অবৈধ নিগ্রহ ও অসহ্য অবজ্ঞার নিবিড় কৃষ্ণ মেঘরাশি যখন তাঁহার সম্মুখে পুঞ্জিভূত হইতে লাগিল তখন তিনি আপন হৃদয়ের গোপন ভাষে আপনিই উন্মত্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি সংকীর্ণ সমাজের বাহ্যাড়ম্বর ও ক্ষুদ্রগণ্ডীর প্রতি ভ্রূ-ভঙ্গী করিয়া বিস্তীর্ণ ও আলোকময় রাজ্যে প্রবেশ করিতে ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। অনন্তর স্বীয় জননী ও অর্দ্ধাঙ্গিনীর নিকট শেষ বিদায় গ্রহণপূর্বক জন্মের মতন গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন ।

যখন তিনি এই সীমাবদ্ধ সমাজের প্রতি ভ্রূকুটি প্রদর্শন করিয়া স্বগৃহ হইতে বিদায় লইলেন তখন তাঁহার প্রাণ কোন অভিনব রাগিণীর মধুর সঙ্গীতে মুখরিত হইয়া উঠিল, যে-রাজ্যের এই সঙ্গীত তথায় প্রবেশ করিতে তিনি আকুল হইয়া পড়িলেন । তিনি এখন সামান্য লালন কর নহেন, তিনি এখন সাঁইজী, এক অদৃষ্টপূর্ব সমাজে প্রবেশ করিয়াছেন । সেখানে অন্ধকারের লেশমাত্র নাই, কেবল জ্যোতি। এই সমাজের কথা উল্লেখ করিয়া তিনি পরে বলিয়াছেন :

চেয়ে দেখ না রে মন দিব্য নজরে

চারি চাঁদ দিচ্ছে ঝলক মণি-কোঠার ঘরে।

লে সে চাঁদের সাধন অধরচাঁদ হয় দরশন,

আবার চাঁদেতে চাঁদের আসন রেখেছে ফিকিরে ।

চাঁদে চাঁদ ঢাকা দেওয়া, চাঁদে দেয় চাঁদের খেওয়া

( দেয় রে)।

জমিতে ফলছে মেওয়া চাঁদের সুধা ঝরে।

নয়ন চাঁদ প্রসন্ন যার সকল চাঁদ দৃষ্ট হয় তার

(হয় রে)।

লালন কয় বিপদ আমার গুরুচাঁদ ভুলে রে।

তাঁহার অন্তরে এই আলোকময় ভাবের উন্মেষ হওয়ায় তিনি ক্ষুদ্র সমাজের অবজ্ঞার প্রতি আর দৃকপাত করিতে পারিলেন না। সিরাজ সাঁইজীর উপদেশে যেখানে ‘চারি চাঁদ ঝলক দিচ্ছেসেই মণি-কোঠার ঘরে গিয়া উপবিষ্ট হইলেন। সুতরাং স্বজাতি বা সমাজের উপেক্ষায় তিনি কেন ঘরের ছেলে পরের হইয়া থাকিবেন! তাই কোন্ সুদূর বন্ধুর আকুল আহ্বানে প্রাণ খুলিয়া সাড়া দিলেন ।

আমি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইয়াছি লালনের স্ত্রী তাঁহার অনুগামিনী হইতে নিতান্ত উৎসুক ছিলেন এবং ইহার পর লালন যখন সেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করেন, তখনও এই পতিপ্রাণা রমণী স্বামীর ধর্ম্মভগিনী হইতে অনেকবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু সমাজের মুখ চাহিয়া আত্মীয়স্বজন কেহই তাঁহার সে ইচ্ছা ফলবতী হইতে দেন নাই। ইহার সামান্য কয়েক বৎসর পরেই লালনের স্ত্রী ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া স্বীয় হৃদয়ের গভীর বেদনা হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন।

লালনের স্নেহময়ী জননীই এখন বিশ্ব-পিতার মমতাময় সংসারে একাকিনী পরিত্যক্তা। তাঁহার গৃহ নির্জ্জন মরুভূমি, তাঁহার প্রাণ আত্মীয়-স্বজনের মমতা হইতেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তিনি একে কাঙ্গালিনী, তাঁহার পর একাকিনী; কেহ তাঁহাকে আর ডাকিয়াও জিজ্ঞাসা করে না । নিরূপায় হইয়া গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নাম স্মরণ করিয়া তিনিও অন্তরঙ্গহীন সমাজ হইতে বিদায় লইয়া ভেকাশ্রিতা হন। প্রাণপ্রতিম পুত্রের অভাবে কেহই আর তাঁহাকে ভুলাইতে পারে নাই। যে সমাজের ভয়ে দেবতার মতন তনয়কে উপেক্ষা করিলেন, সেই সমাজও তাঁহাকে আবরিয়া রাখিতে পারিল না। ভাঁড়রা গ্রামে বৈরাগী “শুম্ভমিত্রের আখড়ায়” তাঁহার জীবনের অবশিষ্টকাল অতিবাহিত হয় এবং

এখানেই তিনি ভবলীলা সম্বরণ করেন। ভাঙ্গুড়ী ফকিরাণী ও পাঁচু সার নিকট শুনিলাম আখড়া হইতে দ্রব্য-সামগ্রী পাঠাইয়া সাঁইজী জননীর মহোৎসবাদি যথাবিধি

সুসম্পন্ন করেন।

সমাজের মুখ চাহিয়া স্ত্রী অকালে কালগ্রস্তা, জননী তথাকথিত আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্তা ও ভেকাশ্রিতা, আর লালন এ-হেন সমাজকে কটাক্ষ প্রদর্শন করিয়া আজ দরবেশ, তিনি সৰ্ব্বজন-পূজিত সাঁইজী। শত শত ব্যক্তি তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া শান্তি-ছায়ায় আশ্রয় লইতেছে, প্রাণরক্ষার জন্য মুসলমানের অন্ন গ্রহণ করার অপরাধে যদিও তিনি মুসলমান তথাপি অনেক সঙ্গতি-সম্পন্ন হিন্দু গৃহস্থ পর্যন্ত তাঁহাকে আপন

গৃহে লইয়া প্রাণের পিপাসা নিবৃত্তি করিতেছে। বঙ্গের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এমন কি স্বর্গীয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পৰ্য্যন্ত তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া শিলাইদহে নৌকায় লইয়া ধর্ম্মালাপে পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। সাঁইজীর নিকট জাতিভেদ নাই, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টিয়ান, সকলে সমানভাবে ধৰ্ম্মপিপাসু হইয়া তাঁহার আখড়ায় যাতায়াত করিতেছেন। সম্প্রতি সাঁইজী যে কোন ধৰ্ম্মাবলম্বী, তাহা নির্ণয় করিবার মতন সাধ্য কাহারও নাই। হিন্দুগণ তাঁহার হস্তে প্রস্তুত অন্নব্যঞ্জনাদি গ্রহণ করিতেন না। সাঁইজীর মাসতুত ভাইগণ পর্য্যন্ত সেঁউড়িয়া আখড়ায় গিয়া স্বহস্তে রন্ধন করিয়া আহারাদি করিতেন। সাঁইজীর শিষ্য ও তাঁহার মাসতুত ভায়ের বংশধরদের মুখে একথা শুনিতে পাইয়াছি। সাঁইজী হিন্দু কি মুসলমান একথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম, এমনকি তিনি নিজেও বলিয়াছেন :

সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন,

লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান ।

তবে মুসলমানের হস্তে প্রস্তুত অন্নব্যঞ্জনাদি ভোজন করিতেন, এই অপরাধে তাঁহাকে মুসলমান বলিয়া সাব্যস্ত করা যায় । তবে প্রকৃত মানব-সমাজের দিক দিয়া বিচার করিলে তাঁহার স্থান ভেদ-জ্ঞান সম্পন্ন ক্ষুদ্র সমাজের বহু ঊর্ধ্বে। তিনি যে-রাজ্যের অধিবাসী, সেখানে হিন্দু-মুসলমানের ভেদ-বিচার নাই, সমগ্র বিশ্ব-মানব তথায় একই জনক- জননীর সন্তান। জাতির কথা উল্লেখ করিয়া ঘরের ছেলেকে পরের হইয়া থাকিতে হয়, লালন সে-রাজ্যের অধিবাসী নহেন। তিনি সমস্ত মনুষ্যের মধ্যে তাঁহার “মনের মানুষ”টিকে দেখিয়ে ভাবে আত্মহারা হইতেন, সুতরাং সমস্ত মানবই তাঁহার চক্ষে এক। তাঁহার কথা “এই মানুষে দেখ সেই মানুষ আছে” । এই মানুষে সেই মানুষ দেখা সামান্য সৌভাগ্যের কথা নহে । লালন পরম ভাগ্যবান, তাই তাঁহার চক্ষে ভেদজ্ঞান সম্পন্ন মনুষ্য দৃষ্ট না হইয়া সৰ্ব্বভূতে বিরাজমান মনুষ্যই সর্ব্বত্র পরিদৃষ্ট হইতে । প্রকৃত কথায় বলিতে গেলে তিনি একজন মনস্তত্ত্ববিদ মহাঋষি। নচেৎ সমস্ত মানবের মধ্যে ভগবদর্শন লাভ সামান্য লোকের ভাগ্যে ঘটে না। ইহাতে অশেষ সাধ্য-সাধনা চাই, লালনের তাহাই ছিল । তাই তিনি গাহিয়াছেন :

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,

লালন ভাবে জেতের কি রূপ দেখলেম না এক নজরে।

যদি, সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,

নারীর তবে কি হয় বিধান?

বামন চিনি পৈতা প্রমাণ,

বামনী চিনি কিসে রে?

কেউ মালা কেউ তসবি গলায়, তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়!

যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়

জেতের চিহ্ন রয় কার্ রে ।

জগৎ বেড়ে জেতের কথা; লোকে, গৌরব করে যথাতথা;

লালন সে জেতের ফাতা

বিকিয়েছে সাধ বাজারে।

এই কথাগুলি শুনিয়া লালনের জাতি পরিচয় লইতে যাওয়া বড়ই সমস্যাময় ব্যাপার । ভেদ-বিচারে যেখানে :

এই মানুষে দেখ সেই মানুষ আছে,

কত মুনি-ঋষি চারি যুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে।

জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়

সে-চাঁদ ধরতে গেলে হাতে কে পায়,

ও যে, আলেক মানুষ তেমনি সদায়

আছে আলেকে বসে।

অচিন দলে বসতি তার,

দ্বিদল পদ্মে বারাম তার;

দল নিরূপণ হবে যাহার

সে রূপ দেখবে অনায়াসে । আমার হল কি ভ্রান্তি মন

আমি বাইরে খুঁজি ঘরেরি ধন

সিরাজ সাঁই কয় ঘুরবি লালন আত্মতত্ত্ব না বুঝে ।

সাঁইজীর প্রথম কথা সর্ব্বাগ্রে নিজের পরিচয় লও ‘কুস্ত্বং কোহয়ং কুত আয়াত। তুমি কে? কি নিমিত্ত কোথা হইতে এই ধরাধামে আগমন করিয়াছ? অন্তিমেই বা তোমার কি গতি হইবে। আত্মপরিচয় অবগত না হইলে জগতে কেহ কখন কোন কার্য্য করিতে সক্ষম হয় না। আমরা মোহান্ধ মানব আপনার পরিচয় রাখি না, কিন্তু বাতুলের মত অচেনা মানুষের সন্ধানে কৃতকাৰ্য্য হইতে যাই। ইহা দেখিয়া লালন বলিয়াছেন :

আপন খবর আপনার হয় না আপনারে চিনলে পরে

যায় অচেনারে চেনা ৷

স্বয়ং নিকট থেকে দূরে দেখায়

যেমন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়

দেখ্‌ না ৷

আমি ঢাকা দিল্লী হাতড়ে ফিরি

তবু কোলের ঘোর ত যায় না।

আত্মারূপে কর্তা হরি

মনে নিষ্ঠা হলে মিলবে তারি

ঠিকানা ৷

বেদ বেদান্ত পড়বি যত

বেড়বে তত লখনা ।

ধড়ের আত্মা কর্তা কারে বলি,

কোন্ মোকাম তার কোথায় গলি,

আওনা যাওনা ৷

সেই মহলে লালন কোন্ জন,

তাও লালনের ঠিক হল না ।

সেঁউড়িয়া আখড়া স্থাপন করিয়া সাঁইজী গৃহস্থের ন্যায় বাস করিতে থাকেন, কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার বিষয়াসক্তি ছিল না। পার্থিব সুখ-দুঃখের প্রতিও তিনি ভ্রমেও দৃকপাত করিতেন না । তাহার মন ‘অধর মানুষধরিবার প্রবল বাসনায় অনুক্ষণ আকুল রহিত । তাঁহার অন্তঃকরণের ভাবরাশি যখন দুকূলপ্লাবিনী তটিনীর ন্যায় আকুল উচ্ছ্বাসে উথলিয়া উঠিত, তখন আর তিনি আত্মসংবরণ করিতে পারিতেন না। শিষ্যগণকে ডাকিয়া বলিতেন, ‘ওরে আমার পুনা মাছের ঝাঁক এসেছে।শুনিবামাত্র শিষ্যেরা যে যেখানে থাকিত ছুটিয়া আসিত। তখন সাঁইজী আপন ভাবের আবেশে গান ধরিতেন; শিষ্যেরাও সঙ্গে সঙ্গে গাহিয়া চলিত । ইহাতে সময়-অসময় কিছু ছিল না, সদা-সৰ্ব্বদাই এই পোনা মাছের ঝাঁক আসিত। তিনি গৃহস্থ হইয়া সদানন্দ-ধামে বাস করিতেন।

পরমহংসদেবের উপদেশে একটি উপমা পড়িয়াছি,— যে ব্যক্তি মাছ ধরিতে বসে, তাহার দৃষ্টি ফাতনার উপরই নিবদ্ধ থাকে; কিন্তু প্রয়োজন মতো সঙ্গীর সহিতও সে কথা বলে। সেইরূপ সংসারের কাজকর্ম্ম করিবে কিন্তু মনশ্চক্ষু পরমেশ্বরেই নিবিষ্ট রহিবে । সাঁইজীরও ঠিক তাহাই ছিল । সংসারের কাজকর্ম্ম করিতেন, এমন-কি মহাযাত্রার ১০/১২ দিন পূর্বেও অশ্বারোহণে দূরস্থ ভক্তবৃন্দের গৃহে যাতায়াত করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার মন (মানসিক চিন্তার ধারা) পরমেশ্বরেই সংযোজিত রহিত । কেবল তাহাই নহে বিষয়াসক্তির প্রতি সর্ব্বদাই সতর্ক ছিলেন। আসক্তি জন্মিবে বলিয়া সৰ্ব্বক্ষণ শঙ্কামুক্ত রহিতেন। তাই বলিয়াছেন :

বিষয়-বিষে চঞ্চল মন দিবা-রজনী,

মন ত বুঝালে বোঝোনা ধর্ম-কাহিনী ।

বিষয় ছাড়িয়ে কবে, মন আশার শান্ত হবে হে!

আমি কবে সে চরণ, করিব শরণ

যাতে শীতল হবে তাপিত পরাণী ।

কোনদিন শ্মশানবাসী হব, কি ধন সঙ্গে লয়ে যাব হে ।

আমি কি করি কি হই, ভূতের বোঝা বই

একদিনও ভাবলেম না শ্রীগুরুর বাণী ।

অনিত্য দেহেতে বাসা, তাইতে এতই আশার আশা হে ।

অধীন লালন তাই বলে নিত্য হইলে

আর কতই কি মনে করতে না জানি ।

অন্তশ্চক্ষু খুলিয়া গেলে মানব আর সংসারের কোন বস্তুর বাহ্যিক অবয়বদর্শনে পরিতৃপ্ত হয় না। তাহার অভ্যন্তরে বিরাজমান প্রচ্ছন্ন জ্যোতির দিকেই দৃষ্টিক্ষেপ করিতে লালায়িত হয় এবং সেই জ্যোতির্ম্ময়ের দিকে আকৃষ্ট হইয়া আপনাতে আপনি বিভোর থাকে। সাঁইজীর ঠিক তাহাই হইয়াছিল । তিনি সাধক-শ্রেণী উত্তীর্ণ হইয়া সিদ্ধরূপে পরিণত হন, নচেৎ আত্মতত্ত্বে এইরূপ পূর্ণ জ্ঞান কি সাধারণ মানবে সম্ভব । এই তত্ত্বের বিষয় আলোচনা করিতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন :

লীলা দেখে লাগে ভয় ।

নৌকার উপর গঙ্গা বোঝাই

ডেঙ্গা বেয়ে যায় ।

আবহায়াত নাম গঙ্গা সেজে সংক্ষেপে কেউ দেখে বুজে

পলকে পাহাড় ভাসে

পলকে শুকায়।

ফুল ফোটে তার গঙ্গাজলে ফল ধরে তার অচিন দলে

যুক্ত হয় সে ফুলে ফলে

তাতে কথা কয় ।

গাঙ্গ জোড়া এক মীন ঐ গাঙ্গে খেলছে খেলা পরম রঙ্গে

লালন বলে জল শুকালে

মীন যাবে হাওয়ায় ।

এই জ্ঞান লাভ পুস্তক-পাঠে হয় না, সাঁইজী ভালরূপ লেখাপড়াও জানিতেন না, রাশি রাশি পুস্তক পাঠও তাঁহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে নাই। এবং এই ‘বইপড়া জ্ঞানও তিনি তাদৃশ আবশ্যক বোধ করেন নাই। পূর্ব্বে উক্ত হইয়াছে যে, আত্মতত্ত্ব লাভই তাঁহার প্রথম উপদেশ এবং কেমন করিয়া এই তত্ত্বে অধিকার জন্মে, তাহাও তিনি নিম্নের গানটিতে বিবৃত করিয়াছেন :

দেল দরিয়ায় ডুবলে সে দরের খবর পায়,

নৈলে পুঁথি পড়ে পণ্ডিত হইলে কি হয়?

স্বয়ং রূপ দর্পণে ধরে, মানবরূপ সৃষ্টি করে হে।

দিব্যজ্ঞানী যারা, ভাবে বোঝে তারা

মানুষ ধরে কার্য সিদ্ধি করে লয়।

একেতে হয় তিনটি আকার, অযোনী সহজ সংস্কার হে।

যদি ভাব-তরঙ্গে তর, মানুষ চিনে ধর

দিনমণি গেলে কি হবে উপায় ।

মূল হতে হয় ডালের সৃজন

ডাল ধরলে পায় মূল অন্বেষণ হে। 

তেমনি রূপ হতে স্বরূপ, তারে ভেবে রূপ

অধীন লালন সদা নিরূপ ধরতে চায় ।

সাঁইজীর সাধন-সৌধের প্রথম সোপান ভক্তি। ভক্তি-ভাবই তিনি সাধকের হৃদয়ে সঞ্চার করিতে প্রয়াসী হইতেন। সে-ভাব সহজ নহে। বিশ্ব ভুলিয়া প্রাণের একমাত্র আরাধ্য দেবতাকে আত্মহারা হইয়া ভালবাসা। যাহা একদিন যমুনা-পুলিন-বিহারিণী, বেণুধ্বনি-উন্মনা গোপিনীগণকে উন্মত্ত করিয়াছিল, ইহার অন্য নাম ব্রজের ভাব । ইহারই উল্লেখ করিয়া সাঁইজী বলিয়াছেন :

সে ভাব সবাই কি জানে?

যে ভাবে শ্যাম আছে বাঁধা গোপীর সনে ।

গোপী বিনে জানে কেবা

শুদ্ধরস অমৃত সেবা

গোপীর পাপ-পুণ্য জ্ঞান থাকে না কৃষ্ণ-দরশনে ।

গোপী অনুগত যারা

ব্রজের সে ভাব জানে তারা,

নীরহেতু অধর ধরা গোপীর মনে ।

টলে জীব অটল ঈশ্বর

তাইতে কি হয় রসিক নাগর;

লালন কয় রসিক বিভোর রস-ভিয়ানে ।

কেবল ইহাই নহে। চৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত প্রভৃতির ভাবেও তিনি বিভোর ছিলেন। এই ভাব যে তিনি কেমন করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন নিম্নের গানটিতে তাহার আভাস পাওয়া যাইবে :

তোরা, কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে,

তিন পাগলের হল মেলা নদে এসে ।

দেখতে যে যাবি পাগল

সেই ত হবি পাগল

বুঝবি শেষে ।

ছেড়ে তার ঘর দুয়ার ফিরবি নে যে।

একটি নারিকেলের মালা

তাইতে জল তোলা ফেলা

করঙ্গ সে।

হরিবোলে পড়ছে চলে ধুলার মাঝে।

পাগলের নামটি এমন

শুনিতে অধীন লালন

হয় তরাসে।

চৈতে, নিতে, অদ্বে পাগল নাম ধরেছে।

মানবের চিত্তচকোর যখন সেই জগজ্জ্যোতিময় সুধাকারের সুধাপানে মাতোয়ারা হয়, তখন সে আর সাধারণ মানব বলিয়া বিবেচিত হয় না। বিশ্বগ্রাসী বিষয়-বাসনার প্রতি বিতৃষ্ণ হইয়া কোনো অনির্বচনীয় এবং অনাঘ্রাতরস আস্বাদন করিতে নিরন্তর উন্মত্ত রহিয়া যায়, তখন সে সংসারে পাগল বলিয়া আখ্যাত হয়। সাঁইজীর সঙ্গীতোক্ত মহাত্মাত্রয়ও এইরূপ পাগল ছিলেন। তিনি ইহা অন্তরের সহিত উপলব্ধি করিয়া এই সঙ্গীত গাহিয়াছেন ।

সাঁইজী যে কেবল এই ভাবই পোষণ করিতেন, তাহা নহে । তিনি সৰ্ব্বজনীন ভাবের ভাবুক ছিলেন। যিনি যে পথেই যান না কেন, অন্তিমে সকলকেই যে একই স্থানে সম্মিলিত হইতে হইবে ইহা বুঝাইয়া তিনি আত্মত্যাগ, অমিত্ব লোপ ও বৃথা আড়ম্বর পরিহার করিয়া ‘অধরেমিশিবার উপদেশ দিয়া গাহিয়াছেন :

সাঁই দরবেশ যারা

আপনারে ফানা করে

অধরে মেশে তারা ।

মন যদি আজ হও রে ফকির

নাও জেনে সে ফানার ফিকির 

ধর অধরা ।

ফানার ফিকির না জানিলে

ভস্মমাখা হয় মস্কারা ।

কূপজলে সে গঙ্গার জল

পড়িলে যে হয়রে মিশাল

উভয় একধারা।

তেমনি জেনো ফানার করণ 

রূপে রূপ মিলন করা।

মুরশিদ রূপ আর আলেক নূরী 

একমনে কেমনে করি দুরূপ নিহারা ।

লালন বলে রূপ সাধিলে 

হসনে যেন রূপহারা ।

সূত্রঃ লালন সমগ্র

আবুল আহসান চৌধুরী

ফ কি র লা ল ন শা হ

বসন্তকুমার পাল

শেয়ার করুন:

অন্যান্য পোস্ট

আরশি নগর কেমন শহর ? বিষয় ফ্রয়েডের আবিষ্কার ও মহাত্মা লালন ফকির | সলিমুল্লাহ খান

এই লেখার বিষয় মহাত্মা লালন ফকির। তবে মালিকের অনুমতি পাই তো প্রথমে বন্দনা করি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ

বিস্তারিত

ফ কি র লা ল ন শা হ | ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালন শাহ ফকিরের কুড়িটি গান সর্বপ্রথম ‘প্রবাসী’র ‘হারামণি’ শীর্ষক বিভাগে প্রকাশিত হয় (প্রবাসী, ১৩২২, আশ্বিন-মাঘ সংখ্যা)। ইহার পূর্বে লালনের

বিস্তারিত

You cannot copy content of this page