Customize Consent Preferences

We use cookies to help you navigate efficiently and perform certain functions. You will find detailed information about all cookies under each consent category below.

The cookies that are categorized as "Necessary" are stored on your browser as they are essential for enabling the basic functionalities of the site. ... 

Always Active

Necessary cookies are required to enable the basic features of this site, such as providing secure log-in or adjusting your consent preferences. These cookies do not store any personally identifiable data.

No cookies to display.

Functional cookies help perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collecting feedback, and other third-party features.

No cookies to display.

Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics such as the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.

No cookies to display.

Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.

No cookies to display.

Advertisement cookies are used to provide visitors with customized advertisements based on the pages you visited previously and to analyze the effectiveness of the ad campaigns.

No cookies to display.

লা ল ন ফ কি রে র গান | ডক্টর মতিলাল দাশ

গত শতকে য়ুরোপীয় সভ্যতা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে বাঙ্গালা-সহিত্যের অভূতপূর্ব উন্নতি হইয়াছে, কথা ও আখ্যায়িকার বন্যায় বাঙ্গালাদেশ ছাইয়া গিয়াছে। কিন্তু তথাপি এই ঋদ্ধির গতির সহিত দেশের নাড়ীর যোগ নাই। বৈষ্ণব কবিদের কবিতা কিংবা ধৰ্ম্ম- মঙ্গলের কবিতা, পাঁচালী এবং ছড়া দেশের মর্ম্মকোষে পদ্মের মত বিকশিত হইয়া আপন সৌরভে দিগন্ত সৌরভান্বিত করিয়াছিল। বর্তমানের যুগ-সাহিত্য তথাকথিত শিক্ষিত বাঙ্গালীর মনের ব্যথা-বেদনাকে প্রকাশ করিয়াছে, কিন্তু মৌন-মুক আপামর জনসাধারণের চিত্তের দ্বারে তাহার অধিকার নাই ।

অজ্ঞাত লোক-সাহিত্যের মাঝে তাহার পরিচয় খুঁজিতে হইবে। বাঙ্গালার জাতীয় জীবনের নির্ম্মল অনাবিল প্রবাহ এই সমস্ত পল্লীকথা ও পল্লী-সঙ্গীতের মাঝেই আপনাকে প্রকাশ করিয়াছে। আজকাল লোক-সাহিত্য সংগ্রহের চেষ্টা হইতেছে, এ চেষ্টা সৰ্ব্বতোভাবে প্রশংসনীয়। বিদেশীয় সভ্যতার বিধান মূল্যবান, কিন্তু তথাপি আপনার নিজস্ব যে খুঁদকুড়া আছে, তাহা অমূল্য। এই সব লোক-সাহিত্য নিভৃত পল্লীর কুটীরে কুটীরে অতীতের সহিত আমাদের প্রাণবন্ত যোগ বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। ইহাদিগকে যথোচিত মর্য্যাদা না দিলে আমাদের জাতীয় জীবনের প্রকাশকে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিব না ।

কুষ্টিয়ায় আসিয়া শুনিলাম যে, কুষ্টিয়ার সন্নিকটেই লালন ফকিরের আখড়া বর্তমান। লালন ফকিরের নাম পূর্বে কিছুকিছু শুনিয়াছিলাম, কৌতূহল বর্ধিত হইল। কোনও কিছু সন্ধান মেলে কিনা, তজ্জন্য চেষ্টায় রহিলাম। কুষ্টিয়ায় সুপরিচালিত পাক্ষিক পত্রিকা দীপিকার স্বত্বাধিকারী শ্রদ্ধেয় শ্রীযুত দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের সৌজন্যে সে সুযোগ মিলিল ।

ফাল্গুনের আম্রমুকুল সুরভিত স্নিগ্ধ প্রভাতে আমরা ফকিরের আস্তানার জন্য রওয়ানা হইলাম । ফকিরের সমাধি কুষ্টিয়ার পাশেই কালীগঙ্গার মরা খাতের পাশে ছেউরিয়া গ্রামে অবস্থিত । লালনের অন্যতম প্রিয়-শিষ্য ভোলাই সা ফকির বাঁচিয়া আছেন । তাঁহার নিকট গুরুর খবর জিজ্ঞাসা করিলাম । ভোলাই সা বিশেষ কিছু জানেন বালিয়া মনে হইল না । তবে লালনের মৃত্যুর সমসাময়িক কালে ‘হিতকরীনামক কাগজে যে বৃত্তান্ত বাহির হইয়াছিল, তাহা ফকিরের নিকট ছিল, তাহাই পড়িয়া লইলাম । ইহাতেই পাই, লালন ১৭ই অক্টোবর শুক্রবার দেহত্যাগ করেন, তখন তাঁহার বয়স ১১৬ বৎসর ছিল । ‘হিতকরীতে’ তারিখ দেওয়া নাই, কাজেই কোন সালের কাগজ, বুঝিতে পারিলাম না, কিন্তু অন্যত্র হইতে পাই যে, তিনি ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে মারা যান, তাহা হইলে তাঁহার জন্মবর্ষ ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দ হইতেছে।

লালনের জীবনকাহিনী সংগ্রহের চেষ্টা করিতেছি— সমস্ত উপকরণ পাইলে তাহা হইতে পরে তাঁহার জীবনচরিত লিখিবার চেষ্টা করিব, আজ তাঁহার গানগুলি পাঠককে উপহার দিব।

ভোলাই সার নিকট হইতে গানের পুঁথি আদায় করিতে যথেষ্ট বেগ পাইতে হইয়াছিল। ভোলাই সা বলিল, “দেখুন, রবিঠাকুর আমার গুরুর গান খুব ভালবাসিতেন, আমাদের খাতা তিনি লইয়া গিয়াছেন, সে খাতা আর পাই নাই, কলিকাতা ও বোলপুরে চিঠি দিয়াও কোনও উত্তর পাই নাই।” এ কথার সত্যতা কতদূর কে জানে? কিন্তু ভোলাই কবিগুরুকে লালনের চেলা বলিয়া মনে করে এবং বলে যে, কবিগুরু লালনের গানকে রূপান্তরিত করিয়াই জগৎ-জোড়া নাম কিনিয়াছেন। বৃদ্ধের এই মিথ্যা অহমিকা দূর করিয়া তাহাকে কষ্ট দিবার প্রয়োজন অনুভব করিলাম না।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ও গানে বাউল-সঙ্গীতের বিশিষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং সম্ভবতঃ তিনি যখন শিলাইদহে ছিলেন, তখন লালন কিম্বা তাঁহার শিষ্যদিগের গান শুনিয়াছিলেন। সে যাহা হইক, বৃদ্ধের অনেক স্তুতি করিয়া কোনও ক্রমে একটি গানের নকল-পুঁথি যোগাড় করিলাম ।

নকল-পুঁথির বানান অনেক ভুল, তাহাকে সংশোধন করিয়া তুলিয়া দিলাম। এই সমস্ত গান ফকির ও দরবেশগণ নদীয়ার ঘরে ঘরে, কেবল নদীয়ার ঘরে ঘরে কেন, প্রায় নিকটবর্ত্তী সকল জেলায় গাহিয়া ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এই গানগুলির অন্তর্নিহিত ভাবগভীরতা রসজ্ঞ পাঠকগণকে নিশ্চয়ই মুগ্ধ করিবে। দর্শন ও সাধারণের উপযোগী ভাষায় এবং ভাবে কি সুন্দরভাবেই না ব্যক্ত করা হইয়াছে।

সাঁই, দরবেশ, বাউল প্রভৃতির গানের মধ্যে উপনিষদুক্ত আত্মতত্ত্বলাভের আকাঙ্ক্ষা নূতন নূতন সহজবোধ্য উপমায় পরিস্ফুট দেখিতে পাই। লালনের গানে অনেক আত্মতত্ত্ববিষয়ক ছড়া আছে। নিচে কয়েকটি উদ্ধৃত করিতেছি :

“আপনারে আপনিরে মন না জান ঠিকানা,

পরের অন্তর কেটে সমুদ্দর, কিসে যাবে জানা?

পর অর্থে পরম ইশ্বর, আত্মারূপে করে বিহার

দ্বিদল বারামখানা, শতদল সহস্রদলে অনন্ত করুণা

কেশের আড়েতে যৈছে, পৰ্বত লুকায়ে আছে

দরশন হল না

এবার হেঁট নয়ন, যার নিকটে তার

সিদ্ধ হয় কামনা ৷৷

সিরাজ সাঁই বলে রে লালন গুরুপদে ডুবে আপন

আত্মার ভেদ জেনে নে না ।

আত্মা আর পরমাত্মা নিত্য ভেদ জেন না ।”

 

যেন বেদান্ত পড়িতেছি, অথচ যার রচনা, তার শিক্ষা অতি সামান্য। নিরক্ষরতা আমাদের দেশে থাকিলেও দেশের কৃষ্টির ও সাধনার মর্ম্মধারা সাধারণের অন্তরে অন্তরে কেমন উৎকৃষ্টভাবে প্রস্ফুট ছিল, এ সমস্ত গান তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যাত্রা, গান, কথকতা, আউল ও বাউল সঙ্গীতের মধ্যে দিয়াই ভারতীয় সংস্কৃতি দেশের মৃত্তিকার গভীরতম স্তরে স্তরে আপনার শিকড় প্রবেশ করাইতে পারিয়াছিল ।

এই পরমার্থতত্ত্বের সহিত গুরুপদ ও নামবাদ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের দেশের সাধনায় গুরুতত্ত্ব কত অধিক প্রভাব বিস্তার করিয়াছে—তাহা যাঁহারা ধর্ম্ম সাধনার বিচিত্র রূপের কিছু কিছু আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারাই জানেন । লালনও গুরুবাদের সমর্থক – গুরুই সেই অজ্ঞাত চরমপথের কাণ্ডারী – তিনিই খেয়া দেন, তাঁহার প্রদত্ত

নামসাধনেই ঐকান্তিক শ্রেয়োলাভ হয় ।

“মুরশিদ বিনে কি ধন আর আছে রে মন এ জগতে

যে নাম স্মরণ হরে, তাপিত অঙ্গ শীতল করে

ভবন্ধন দূরে যায় রে জপো নাম দিবা-রেতে।

মুরশিদের চরণ-সুধা পান করিলে যাবে ক্ষুধা,

করো নারে দেখে দ্বিধা যেহি মুর্শিদ সেহি খোদা

রোজ এলিএম মুর্শিদা আয়েত লেখা কোরানেতে ।

আপনি খোদা আপনি নবি আপনি সে আদম ছবি,

অনন্ত রূপ করে ধারণ কে বোঝে তার নিরাকরণ

নিরাকার হাকিম নিরঞ্জন, মুর্শিদ রূপ ভজন পথে ।

কুল্লে সাঁই সহিত আরো আল্লাকুল্লে সাই কাদিরো

পরড় কালাম নেহাজ করো তবে সব জানিতে পারো

কেনে লালন ফাকে ফেরো ফকিরি নাম পাড়াও মিথ্যে।”

 

মুরশিদ গুরু, গুরুই মুক্তিপথের অগ্রদূত। এই কবিতায় মুসলামান ধর্ম্মের অনেক রীতিনীতির উল্লেখ আছে কিন্তু লালন মুসলমান ছিলেন বলিলে ভুল হইবে।

লালনের ধর্ম্মমত উদার বিশ্বজনীন। লালন ফকির হওয়ার পূর্ব্বে হিন্দু ছিলেন এবং পরে সিরাজ সাঁই দরবেশের নিকট দীক্ষিত হন – কাজেই তাঁহার লেখায় হিন্দু এবং মুসলমান উভয় ধর্ম্মের সাধন-ভজনের প্রক্রিয়া ও পন্থার উল্লেখ দেখা যায় । কিন্তু আসলে তিনি মুসলমান নন । কারণ তাঁহার সাধনায় নমাজের স্থান নাই – কবীর প্রভৃতি মধ্যযুগের সাধকগণের মত তিনি মুসলমান ধর্ম্মের একেশ্বরবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন । বৈষ্ণবসাধনার কাঠামোর উপর মুসলিম সাধনার সমন্বয় করিয়া তিনি তাঁহার বিশিষ্ট ধর্ম্মমতের উদ্ভব করেন। বারান্তরে তাঁহার ধর্ম্মমত ও সাধনার কথা সবিস্তার বর্ণনা করিবার বাসনা রহিল ।

পারে যাওয়ার নাম খেয়া। তাই লালন গাহিলেন :

 

“আয় কে যাবি ওপারে?

দয়ালচাঁদ মোর দিচ্ছে খেয়া অপার সাগরে।

যে দিবে সেই নামের দোহাই তারে দয়া করবেন গোঁসাই

এমন দয়াল আর কেহ নাই, ভবের মাঝারে।

পার করে জগৎ বেড়ি নেয় না পারের কড়ি

সেরে সুরে মনের দেড়ি ভার দেনা তারে।

দিয়ে ঐ শ্রীচরণে ভার, কত অধম হল পার

সিরাজ সাঁই কয় লালন, তোর বিগার যায় না রে।”

 

গীতার সেই শরণাপত্তির কথা। সেই আত্মসমর্পণের বাণী, সেই আত্মনিবেদনের সহজ সাধনার প্রীতি ও প্রেমভাবের কথা তাঁহার অনেক গানে দৃষ্ট হয়। “হিতকরী’তে দেখিলাম, সাধুসেবা নামে তাঁহার সম্প্রদায়ে ব্যাভিচারাদি চলে। লালনের শিষ্যগণের শুনিলাম সন্তানাদি হয় না—ইহার পিছনেও ইন্দ্রিয়পিপাসাকে অস্বাভাবিক উপায়ে বিবর্তিত করিবার প্রচেষ্টা বর্তমান। লালন দরবেশ। বুঝা যায় বৌদ্ধ-তান্ত্রিক সাধনা ও সহজ সাধনা মুসলমান সাধনার সহযোগে এক নূতন পদার্থরূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল ।

 

“শুদ্ধ প্রেমের প্রেমী মানুষ যে জন হয়,

মুখে কথা ক’ক না ক’ক, নয়ন দেখলে চেনা যায়।

মণিহারা ফণী যেমন, প্রেম-রসিকের দুটি নয়ন

কি দেখে কি করে সে জন কে তাহার অন্ত পায়?

রূপে নয়ন ঝরে খাঁটি, ভুলে যায় সে নাম অস্ত্রটি,

চিত্র গুপ্ত তার পাপ পুণ্য কিরূপ লেখে খাতায়?

গুরুজি কয় বারে বারে, শোন রে লালন বলি তোরে

তুমি মদন-রসে বেড়াও ঘুরে সে প্রেম সনে কই দাঁড়াও?”

 

এই প্রেম-ভক্তির কবিতায় কিন্তু ইহাদের গুহ্য সাধনের কোনই ইঙ্গিত নাই; বৈষ্ণবী প্রেম-সাধনার কথাই যেন শুনিতেছি। চণ্ডিদাস, বিদ্যাপতি প্রভৃতি সাধক কবিদের কণ্ঠে যে প্রেমমাধুর্য্যরসের ফোয়ারা ছুটিয়াছিল, লালনের গানে বাঙ্গালায় সেই নিজস্ব ধরন নূতনরূপে ব্যক্ত করিয়াছে, বাঙ্গালার এই সহজ-সাধনা, বাঙ্গালার এই বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা— ইহাদের মর্ম্মরস আজিও সংগৃহীত হয় নাই— সমস্ত উপকরণ আজিও সংগ্রহ হয় নাই, কিন্তু সংগ্রহের চেষ্টাও বিরল। গূঢ় সাধনার একটি পদ তুলিতেছি :

 

“ধর রে অধরচাঁদেরে অধর দিয়ে,

ক্ষীরোদ মৈথুনের ধারা, ধররে রসিক নাগরা

যে রসেতে অধর ধরাতে করে সচেতন হয়ে ।

অরসিকের বোলে ভুলে, ডুবিসনে কূপ-নদীর জলে

কারণ-বারির মধ্যস্থলে ফুটেছে ফুল অচিনদলে

চাঁদ-চকোরা তাহে খেয়ে প্রেমবানে প্রকাশিয়ে ।

নিত্য ভেবে নিত্য থেকো, নিলে বাসে যেও নাকো,

সে দেশেতে মহা প্রলয় মায়েতে পুত্র ধরে খায়

ভেবে বুঝে দেখ পুনরায় এমন দেশে কাজ কি যেয়ে।

পঞ্চবানের ছিলে কেটে, প্রেম যাচো স্বরূপের পটে

সেরাজ সাঁই বলে রে লালন বৈদিক বাণে করিসনে রণ

বাণ হারায়ে পড়বি তখন রণ-খেলাতে হুমড়ি খেয়ে ।”

 

ইহার ব্যাখ্যা আজ করিব না— সহজ-সাধনার বিস্তৃত ইতিহাস না দিয়া সে ব্যাখ্যা সম্ভব নহে, তার উপর এই দুরূহ বিষয়ে আমার জ্ঞান নিতান্তই অল্প। কাম ও প্রেমের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের পরিচয় ইহাতে পাই –কামকে ত্যাগ করিয়া প্রেমের অপূর্ব মাধুর্যে মুক্তির স্বাদ লইবার জন্য চেষ্টা ইহার মধ্যে প্রকাশ পাইয়াছে। রসিক ও সাধক না হইলে এই প্রেমতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিতে যাওয়া কষ্টসাধ্য—ইহার অনেক কথাই উহ্য, অন্তর দিয়া অনেক অনুভব করিতে হয়।

এইসব সাধনায় মানুষকে উচ্চ আসন দেওয়া হইয়াছে । আজকাল এই মানুষ-তত্ত্বকে বর্তমান যুগের মানবতা-বাদের (Humanity) সহিত মিলাইবার চেষ্টা চলিয়াছে, কিন্তু তাহা এই হিসাবে অত্যন্ত ভুল। চণ্ডিদাসের কবিতায় :

“শুন হে মানুষ ভাই ।

সবার উপরে মানুষ সত্য,

তাহার উপরে কিছুই নাই।”

ইহার অর্থ মনুষ্যত্বের পূজা নয় । ইহার অর্থ এই মানুষের মধ্যেই পরমাত্মা আছে— তাহার উপলব্ধি হইলেই মুক্তি ও কৈবল্য লাভ হয়। লালনের কবিতাতেও এই সহজসাধনায় মানুষ-তত্ত্বের পরিচয় পাই :

“মানুষ-তত্ত্ব যার, সত্য হয় মনে

সে কি অন্য তত্ত্ব মানে?

মাটির ঢিপি কাঠের হবি ভূত ভাবী সব দেবাদেবী

ভোলে না সে এ-সব রূপি ও যে মানুষ রতন চেনে ।

জোরই ফোরই নোলা পেঁচ পেঁচি এলো ভোলা,

তাতে নয়নে ভোলনেয়ালা মানুষ ভজে দিব্য জ্ঞানে।

ফেও ফেপি ফেকসা যারা ভাকা ভুকোয় ভোলে তারা 

লালন তেমনি চটা-মারা ও ঠিক দাঁড়ায় না একখানে।”

 

ইহাতে দেবপূজা, যাগযজ্ঞ প্রভৃতির নিরর্থকতা বলা হইতেছে। কিন্তু, যে মানুষ- পূজার কথা হইতেছে— সে মানুষ man নয়, সে মানুষ মানুষের অন্তর্যামী আত্মা । নিম্নের কবিতায় ইহার সত্যতা উপলব্ধি হইবে :

 

“এই মানুষে সেই মানুষ আছে,

কত মুণি-ঋষি চার যুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে।

জলে যেমন চাঁদ দেখা যায় ধরতে গেলে হাতে কে পায়

তেমনি সদায় আছে আলেকে বসে

অচিন দলে বসতি ঘর, দ্বিদল পদ্মে ‘বারামতার

ও সে দল নিরূপণ হবে যাহার দেখবে অনায়াসে ।

আমাম হলো কি ভ্রান্তি মন, আমি বাইরে খুঁজি ঘরের ধন,

দরবেশ সেরাজ সাঁই কয়, ঘুরবি লালন আত্মতত্ত্ব না বুঝে।”

 

সময় থাকিতে তাই সাধনার প্রয়োজন । আপনাকে বুঝিবার জন্য আপনাকে জানিবার জন্য চেষ্টা সময় থাকিতে করিতে হইবে। লালন বলিতেছেন :

“সময় বুঝে বাঁধাল বাঁধলে না,

জল শুকাবে মীন পলাবে পস্তাবিরে ভাই মনকানা ।

তিরপিনির তীরে ধারে মীনরূপে সাঁই বিহার করে,

উপর উপর বেড়াও ঘুরে সে গভীরে ডুবলে না ।

মাস অন্তে মহাযোগ হয়, নীরস হইতে রস ভেসে যায়,

করিয়ে সে যোগের নির্ণয়, মীনরূপ খেল দেখলে না ।

জগৎ-জোড়া মীন অবতার, তার মর্ম্মে আছে সন্ধির উপর 

সিরাজ সাঁই কয় লালন রে তোর সন্ধানীকে চিনলে না।”

পারের উপায় দয়ালচাঁদের দয়ার উপর নির্ভর। তাই একান্ত ভক্তিভরে লালন গাহিতেছেন :

“এস দয়াল আমার পার করো, ভবের ঘাটে

দেখে ভব-নদীর তুফান, ভয়ে প্রাণ কেঁদে উঠে। 

পাপ-পুণ্য যতই করি, ভরসা কেবল তোমারি 

তুমি যার হও কাণ্ডারী ভবভয় তার যায় ছুটে। 

সাধনের বল ছিল যার, তারা কূল-কিনারা পেল

আমার দিন বাজে গেল কি জানি হয় ললাটে । 

পুরাণে শুনেছিলাম খবর পতিত পাবন নাম তোর

লালন কয় আজ আমি পামর, তাইতে দোহাই দিই বটে।”

 

এই সংসারকে দুঃখের আগার মনে করা ভারতীয় সাধনার আদিম যুগ হইতে বর্তমানকাল পর্য্যন্ত একইভাবে আছে। জন্মকে আমরা যন্ত্রণা মনে করি, সেই যন্ত্রণার হাত হইতে মুক্তির পন্থাই খুঁজিয়া ফিরিতেছি।

“এমন মানব জনম আর কি হবে?

মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।

অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই এই মানবের তুলনা কিছুই নাই

দেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে ।

কত ভাগ্যের ফলে না জানি মনরে পেয়েছ মানব-তরণী,

বেয়ে যাও ত্বরায় তরি সুধারায় যেন ভরা না ডুবে ।

এই মানবে হবে মাধুৰ্য্যভজন, তাই মানুষরূপে গড়ল নিরঞ্জন

এবার ঠকলে আর না দেখি কিনারা, লালন কয় কাতরভাবে।”

আর উদ্ধার করিব না, যাহা করিয়াছি, তাহা হইতে রসজ্ঞ পাঠক বুঝিবেন, এইসব অবজ্ঞাত অনাদৃত কবিতার মাঝে আমাদের দেশের চিরপরিচিত সুর কেমন মধুর ঝঙ্কারে বাজিতেছে । ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত এই গানের সহিত দশম শতাব্দীর লেখার অভঙ্গ যোগ বৰ্ত্তমান ।

লালনের প্রায় ছয়শত গান সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি — আরও পাওয়া যায় কিনা, চেষ্টা করিতেছি। লালনের গান কোথাও ছাপা হইয়াছে কিনা, জানি না। কৌতূহলী এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠক সংবাদ জানাইলে কৃতজ্ঞ হইব।

এই গানগুলি বাঙ্গালার সরস-চিত্তের চির-পুরাতন সুরে গ্রথিত—ইহার ভাব, ইহার ইহার ভঙ্গী, ইহার বৈশিষ্ট্য সকলই আমাদের নিজস্ব । প্রগতিশীল বাঙ্গালার নরনারী এই সমস্ত সত্যকার স্বকীয় সঙ্গীতগুলির যথোচিত মর্য্যাদা দিবেন, এ শুভ-বিশ্বাস আমরা পোষণ করি।

শেয়ার করুন:

অন্যান্য পোস্ট

আরশি নগর কেমন শহর ? বিষয় ফ্রয়েডের আবিষ্কার ও মহাত্মা লালন ফকির | সলিমুল্লাহ খান

এই লেখার বিষয় মহাত্মা লালন ফকির। তবে মালিকের অনুমতি পাই তো প্রথমে বন্দনা করি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ

বিস্তারিত

ফ কি র লা ল ন শা হ | ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালন শাহ ফকিরের কুড়িটি গান সর্বপ্রথম ‘প্রবাসী’র ‘হারামণি’ শীর্ষক বিভাগে প্রকাশিত হয় (প্রবাসী, ১৩২২, আশ্বিন-মাঘ সংখ্যা)। ইহার পূর্বে লালনের

বিস্তারিত

You cannot copy content of this page