“ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
হিন্দু কি যবন তাঁর জাতের বিচার নাই”
ফকির লালন সাঁইজি জগতের সকল প্রেমিক রসিক ভক্ত সুহৃদ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর ধামে। সাঁইজি সকলের, সকলে সাঁইজির। ভক্ত বা প্রেমিক মাত্রই তার দুয়ারে সাঁইজি হাজির। ব্রাত্য অচ্ছুৎ সর্বহারা মানবের মহা মিলনের গীত গেয়ে, আমাদের সামনে সদা বর্তমান সাঁইজির জ্ঞানপদ সমূহ। সাঁইজি লালন ফকির কে জানা বোঝা বা তাঁর মহাভাবের রাজত্বে বিচরণের পথ তাঁর পদ/গান। সেই পদ/গান কে আশ্রয় করে ফকির লালন সাঁইজির চিন্তা চৈতন্য, ভক্তি ভাব, ভজন সাধন কে সাধ্য করে শরণ নিয়ে ‘যে জানে ফানার ফিকির সেই জানে ফকিরী’ মত কে অবলম্বন করে যে মহন্ত সাধু ফকির গণ সাধনায় রত আছেন তাঁরাই পারেন সাঁইজির দিশা বাতলে দিতে।
মায়ায় ঘেরা জগত সংসার টিকে আছে নানাবিধ জাত-পাত, ধর্ম, লিঙ্গ, ধনী গরিব, আশরাফ-আতরাফ বৈষম্য বিবেচনায়। যদি কেউ এই ভেদ বৈষম্য থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চান, তাতেও আমাদের বাঁধ সাধে। কেউ বৈষম্য ভেদজ্ঞান করবে না, তাও আমাদের সহে না।
এই ইতিহাস জেনে ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-
জগত বেড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জাতের ফাতা
পুড়িয়েছি সাধ বাজারে।।
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতের কি রূপ দেখলাম না নজরে।।
ফকির লালন সাঁইজি সংসারে জাতের কি রূপ নজরে না দেখলেও আমাদের পন্ডিত গবেষকগণ সাঁইজির জাত ধর্ম খুঁজতে খুঁজতেই হয়রান। তাঁর ভাবের ঘরে তো এদের প্রবেশ নাই। তাই বৃথাই আস্ফালন করেন, নাম কামাবার ধান্দায়।
❝সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।।❞
সাঁইজি সন্ধান না জানলেও, বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা যত প্রবন্ধ/গবেষণা পত্র লিখেছেন তার অধিকাংশের মধ্যেই তিঁনি হিন্দু নাকি মুসলমান সেই নিয়েই খোঁচাখুঁচি করেছেন। জাত-পাত বিরোধী যে লড়াই সাঁইজি চালু করেছেন সেই লালন ফকিরকে নিয়াই জাতের বজ্জাতি করে ওনারা কি প্রমাণ করতে চাইছেন?
কেউ খুঁজে পান হিন্দু, কেউ মুসলমান। অথচ সাঁইজি তার পদ/ গান কোথাও নিজের সম্পর্কে এইসব কুলগীত করেন নাই। সাঁইজির ভক্ত পরম্পরায় কোন সাধু ফকির তাঁর পূর্বাশ্রম নিয়ে কিছু জানেন না। গুরু পরম্পরায় এইটুকুই শুনি, কালী গঙ্গা নদীতে কলাগাছের ভেলায় ভেসে পক্স জ্বরে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃতপ্রায় এক তরুণ ছেঁউড়িয়ার ঘাটে ভিড়েছিলেন। সাঁইজি বলেছেন-
❝আমি লালন একশিরে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে
ভুগেছিলাম পক্স জ্বরে
দরবেশ সিরাজ সাঁই করলেন উদ্ধার।।❞
ফকির লালন সাঁইজি তাঁর সমগ্র পদ/গান সমূহে নিজেকে কেবল “ফকির” হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। মূঢ়, ভেড়ো, অবোধ, অভাগা সহ নানা হীন/নিচু বিশেষণ এ বিশেষায়িত করেছেন নিজেকে, আর গুরু সিরাজ সাঁই কে ডেকেছেন ❝দরবেশ❞ অভিধায়। কিন্তু বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা সাঁইজি দেহরক্ষার পর যত প্রবন্ধ লিখেছেন তার অধিকাংশে “বাউল সম্রাট” খেতাব নিয়ে আসলেন কোথা থেকে? তা সাধু ফকিরদের কাছে বোধগম্য নয়। সাঁইজি যা নিজেকে বলেন নি, তা তাঁর নামে প্রচার করা অনৈতিক। “বাউল” একটা আলাদা মত পথ। ফকির স্বতন্ত্র।
❝জ্যান্তে মরার পোষাক পরা
আপন ছুরাত আপনি সারা
ভব রোগকে ধ্বংস করা
দেখে অসম্ভব করণী।।❞
ফকির লালন সাঁইজির পদ/গান অনুসারে পাই, পূর্বসুরী দুই মহতকে তিঁনি ‘ফকির’ অভিধায় অভিসিক্ত করেছেন। অথবা বলা যায় দুই চিন্তার সাথে তাঁর চিন্তার সংহতি জানিয়েছেন।
❝মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো
বলেছিল আমি সত্য
সই প’ল সাঁইর আইন মত
শরায় কি তার মর্ম পায়।।❞
‘আনা আল হক্ব’ অর্থাৎ আমিই পরম সত্য উক্তির মাধম্যে শরিয়তি বুদ্ধিজীবীদের রোষানলের ফলশ্রুতিতে লম্বা বিচার-প্রক্রিয়ার পরে আব্বাসীয় খলিফা আল মুকতাদির এর আদেশে শূলে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবনে মানসুর আল-হাল্লাজ কে ৯২২ খ্রিস্টাব্দে। ‘আনা আল হক্ব’ বা “আমিই পরম সত্য”, যা তিনি নিয়েছিলেন ভারত ভ্রমণের সময় মহাবাক্য দর্শনের “অহম ব্রহ্মাস্মি” থেকে। এর কারণে তৎকালীন সময়ে এই ধারণা গড়ে উঠে যে, তিনি খোদাত্ব দাবি করছেন। যেহেতু আল-হাক্ক বা “প্রকৃত সত্য” বা “চরম সত্য” যা আল্লার ৯৯টি নামের একটি নাম। আরেকটি চরম বিতর্কের তৈরী হয় যখন তিঁনি ( মানসুর হাল্লাজ) দাবি করেন যে, “আমার পাগড়িতে শুধু খোদা ছাড়া আর কোনো কিছুই প্যাঁচানো নেই” এবং একই ভাবে তিঁনি তাঁর জামার দিকে ইশারা করে বলেন যে, “আমার জামার ভিতরে খোদা ছাড়া আর কেউ নেই”।
সাঁইজি বলেন-
❝আল্লা কে বোঝে তোমার অপার লীলে
তুমি আপনি আল্লা ডাক আল্লা বলে।।❞
অথবা
❝যিনি মুরশিদ রাছুল উল্লা
সাবুদ কোরান কালুল্লা
আশেকে বলিলে আল্লা
তাও সে হয়।।❞
অন্য আরেক পাগল, যিঁনি বঙ্গের, যাঁর বৈষ্ণব ভাব-ভক্তি, একই অংগে রাঁধা-কৃষ্ণের অনুরাগ, সাঁইজির ফকিরি চৈতন্যের অনূরূপ, তাই বলেছেন-
❝ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে
এমন বয়সে নিমাই ঘর ছেড়ে ফকিরি নিলে।।❞
গৌড়বঙ্গের নদিয়া অন্তর্গত নবদ্বীপে শ্রীজগন্নাথমিশ্র ও শ্রীমতী শচীদেবীর গৃহে ১৪৮৬ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন শ্রীবিশ্বম্ভর মিশ্র, গাঁয়ের বরণ গৌর বলে তাঁর আরেক নাম গৌরাঙ্গ, যিঁনি নিম গাছ তলায় জন্মে ছিলেন বলে মা ডাকতেন নিমাই, নদীয়ার বিখ্যাত ‘নিমাই পন্ডিত’। সর্বশাস্ত্রে যিনি তুখোড়। ‘নব্য ন্যায়’ দের জামানায় এই তরুণ শাস্ত্রবিদ তর্কে নৈয়ায়িকদের হারিয়ে দিয়েছেন। জাতিভেদ উপেক্ষা করে তিঁনি সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষদের বুকে জড়িয়ে ধরে “হরি বল” ধ্বনি বিলিয়েছেন, সর্ব প্রাণে করঙ্গের জল পান করিয়েছেন, উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, যবন-শুদ্র, নারী পুরুষ সব নিয়ে সর্বত্র প্রেম ছড়িয়েছেন। মৃদঙ্গ (শ্রীখোল)-করতাল সহযোগে অনুগামীদের নিয়ে নবদ্বীপের রাজপথে ‘নগর সংকীর্তন’-এ বের হতেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। অত্যাচারী জগাই ও মাধাইকে তিনি ভক্তেরূপে পরিণত করেন। তাঁর ভাবে মুসলমান ‘যবন’ (হরিদাস ঠাকুর) বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন । চৈতন্যভাগবত-এ আছে, জাতিভেদের অসারতা দেখানোর জন্য তিনি শূদ্র রামরায়কে দিয়ে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়েছিলেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে কাঞ্চন নগরে স্বামী কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসাশ্রমে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই পণ্ডিত থেকে শ্রীমন্ কৃষ্ণচৈতন্যদেব ভারতী নাম গ্রহণ করেন।
সাঁইজি গেয়েছেন-
❝ধন্য রে ভারতী যিনি
সোনার অংগে দেয় কৌপিনী
শিখাইলে হরি ধ্বনি
কড়েতে করঙ্গ দিলে।।❞
ফকির লালন সাঁইজির ‘ফকিরি’ ভাবের পূর্বতন পরম্পরা হলেন, উল্লেখিত দুই মহাত্মা ফকির। একই সময়ে সাঁইজি যখন ইহ ধামে বর্তমান থাকাবস্থায় ‘পাঁচ ঘর’ বা গদিমান্য করেছেন। অর্থাৎ এঁনাদের সাথে সাঁইজির ভাব-ভক্তি, করণ সাধন, এ ঐক্য হয়েছে। এঁনারা যথাক্রমে- খন্দকার পাঞ্জু শাহ, দেলবার শাহ, উজ্জ্বল চৌধুরী ও সতী মা। বর্তমানেও ফকির লালন সাঁইজির পরম্পরার সাধুসঙ্গে বর্ণিত ঘর সমূহ মর্যাদাপূর্ন্য গদিমান্য। পাঁচঘর একত্রিত হয়ে পূর্ন সাধুসঙ্গ রচিত হয়।
‘হিতকরী’ [ পাক্ষিক, কুষ্টিয়া ] ১৫ কার্তিক ১২৯৭/ ৩১ অক্টোবর ১৮৯০ সংখ্যা মারফত, “ম হা ত্মা লা ল ন ফ কী র” শিরোনামে আমরা জানতে পাই, ‘ইনি (লালন ফকির) ১১৬ বৎসর বয়সে গত ১৭ অক্টোবর (১৮৯০ খ্রিঃ) শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন”। সাঁইজি দেহরক্ষার কিছুকাল পরে শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে, জমিদারী দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন । ঠাকুর মহাশয় সংগ্রাহক ছিলেন। ছেঁউড়িয়ায় অবস্থিত ফকির লালন সাঁইজির ‘হকের ঘর’ বা আঁখড়াবাড়িতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এবং সাঁইজির ভক্ত-শিষ্যদের কাছ থেকে পদ/গানের খাতা সাথে নিয়ে যান। একথার সূত্র পাই, ফকির লালন সাঁইজির খিরকাধারী ভক্ত ও আখড়াবাড়ির ‘ছোট ফকির’ ভোলাই শাহ ফকির’র সাথে কুষ্টিয়ার মুন্সেফ মতিলাল দাস এর কথোপকথন- “দেখুন রবিঠাকুর আমার গুরু (ফকির লালন সাঁইজি)’র গান খুব ভালবাসিতেন,আমাদের খাতা (সাঁইজির পদ/গান সম্বলিত) তিনি লইয়া গিয়াছেন,সে খাতা আর পাই নাই,কলিকাতা ও বোলপুরে চিঠি দিয়াও কোন উত্তর পাই নাই”। (‘লালন ফকিরের গান‘ : মতিলাল দাস। লালন স্মারকগ্রন্থ। ঢাকা। পৃ.৩৭।)
১৯৩৬ সালে, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, লালন ফকির‘র আশ্রমের গান সংগ্রহের জন্য ভোলাই শাহ ফকির ও অন্যদের সঙ্গে দেখা করলে তাঁরা জানান, “সাঁইজির আসল খাতা শিলাইদহের রবিবাবু মশায় লইয়া গিয়াছেন“।
কুষ্টিয়ার মহকুমা–শাসক এবং প্রখ্যাত লেখক অন্নদাশংকর রায়ের কাছে, “গ্রামবার্তা প্রবেশিকার” সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র ভোলানাথ মজুমদার এবং লালন ফকিরের শিষ্যবর্গরা, ফকির লালন সাঁইজির “আসল পুঁথিখানা” কবিগুরুর কাছ থেকে উদ্ধার করতে আবেদন এবং সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে রবীন্দ্র–পরিবারের পক্ষ থেকে ফকির লালনের গানের দুটি খাতা (পান্ডু লিপি নং– ১৩৮ [এ] ১; ১৩৮ [এ] ২) জমা দেয়া হয় রবীন্দ্র–ভবনের গ্রন্থাকারে। যে গানের খাতা মূলত ফকির ভোলাই শাহের, তাঁর জগৎগুরু সাঁই লালন ফকির‘র গান/পদ’র আদি প্রামাণ্য সংগ্রহ।
যে খাতার মলাটে লেখা আছে, ‘শ্রী লালন সাঁই দরবেশের তালেব শ্রী ভোলাই শাহ ফকির এই বহির মালিক‘। এখন প্রশ্ন হইল, যে খাতার মালিক ফকির ভোলাই শাহ সে খাতা কি করে রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্র ভবন কুক্ষিগত করে রাখে? এ কি জমিদারের স্বেচ্ছাচারিতা নয়?
আরেক জমিদার, জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বরাতে একখানা স্কেচ দেখিয়ে প্রচার করা হয়, সাঁইজি’র ছবি বলে। কথিত বোটের উপর চেয়ারে বসা যে প্রতিকৃতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছেন তা কল্পনাপ্রসূত। কেননা, গোঁফ ছাটা অবয়ব ঠাকুর বাড়ির “মুসলমানী কল্পরূপ“, যেখানে সর্বকেশ ধারণ ফকিরি পরম্পরায় বিকশিত চিন্তা সে খবর জমিদারের জানার কথা না তা সহজেই অনুমেয়।
ফকির লালন সাঁইজির চিন্তার বিরোধী বিমুখী বিপক্ষের শক্তি বরাবরই ঠাকুর বাড়ি; এ কথা বললে হয়ত বাঙালী রাবীন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা তেড়ে আসবে। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী তার “পল্লীর মানুষ রবীন্দ্রনাথ” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ফকির লালন সাঁই’র সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে সাঁইজির দৈহিক রূপের বর্ণনা করেন এমন করে – “বৃদ্ধের (সাঁই লালন ফকির) গায়ের রঙ বেশ ফরসা, গায়ে মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় লম্বা চুল ঝুঁটি করে বাঁধা। মুখে পাকা লম্বা দাড়ি নারদ- ঋষির মত। চেহারাখান বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত”
ফকিরি কোন স্থুল ধর্মচর্চা না। ফকিরি কোন গান–বাজনাও না। ফকির সুরে সুরে যা ব্যক্ত করে তা নিগূঢ় দর্শন।
❝সব সৃষ্টি করল যেজন তারে সৃষ্টি কে করেছে
সৃষ্টি ছাড়া কিরূপে সে সৃষ্টিকর্তা নাম ধরেছে।।❞
এই উক্তির মধ্য দিয়া ফকির লালন সাঁইজি তাবৎ দুনিয়ার সকল ধর্ম ও তাদের সৃষ্টিকর্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সেই প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে, বা অনুধাবনে না গিয়ে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের লেখা তত্ত্বাবধানে কথিত ‘আধুনিক সাহিত্য’ দিয়া ফকির লালনের সময়কালরে ‘সাহিত্যের মাৎস্যন্যায়(অন্ধকারযুগ)’ বইলা পশ্চিমে মুখ ঘুরাইছে কথিত বুদ্ধিজীবিরা। অথচ আধুনিক সাহিত্য মানে যে সাহিত্য মানুষের চরম ও পরম উত্থানের দেশনা দেয়, সে হিসেবে লালন ফকিরই তো আধুনিক সাহিত্যের পুরোধা। আবার কেউ তাঁরে ‘বাউল সম্রাট‘ বানাইয়া নাচাকোদা করতেছে হাজার বছরের সংস্কৃতির সাইনবোর্ড নিয়া, আবার কেউ তাঁরে দিয়াই আল্লা–ভগবান খোঁজার ব্যবসা চালু করে, হায় সেলুকাস ! সাঁইজির ফকিরি বুঝতে যে চৈতন্যের দরকার তা অধিকাংশ গ্রাস করে ফেলছে আমাদের স্থুল ধার্মিকতা, কথিত ফোক কালচার বা সাব-অল্ট্রান এনজিও ব্যবসা আর বাকিটা খেয়ে ফেলছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক চাটুকারিতা। তাই ব্যঙ্গ করে সাঁইজি বলেন–
❝মন তুই কি ভেড়ুয়া বাঙ্গাল জ্ঞানছাড়া
সদরের সাজ করছ সদাই পাছ বাড়িতে নাই বেড়া❞
যে আকুতির তরে, হৃদয়ের গহীন থেকে উদ্ভাসিত কি এক অজানা অমোঘ টানে আমরা তন্ময় হয়ে যাই প্রায়শই। তাঁরে খুঁজতেই, তাঁরে ধরতেই কত দিগ-দিগন্তে যেন ছুটে চলা, অথচ সাঁইজি সে পরমের সন্ধানে গেয়েছেন-
❝হাতের কাছে হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর❞
দিল্লি লাহোর যেতে সাঁইজি মানা করেননি কিন্তু যারে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকে খুঁজতে বিদেশ বিভুয়ে যাওয়াটা বোকামিই বটে। বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা সাঁইজির কালামের দার্শনিকতা খুঁজতে পশ্চিমের মনিষীদের দ্বারস্থ হয়েছেন, যেন রেনে দেকার্ত, মার্টিন হেইডেগার, লিও টলস্টয় দ্বারা সিদ্ধ না হলে দর্শন হবে না! ❝আপনার আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে❞ সাঁইজির এমন দর্শনকে অপর দ্বারা টেস্ট করার মানে সাঁইজির স্বরূপ দর্শন না বোঝার লক্ষণ নয় কি?
কলোনিয়াল মনের নিজস্বতা বলে কিছু নাই , এনাদের পক্ষে বা আমাদের পক্ষে ❝আপনাকে আপনি চেনা / সেই বটে মূল উপসনা❞ সাঁইজির এই আত্মদর্শন বোঝা সাধ্য নয়। তাই আমরা বার বার ঘুরে ফিরে আমাদের লালসার কাছে ফিরি, আমাদের অবদমিত কামনার কাছে জবেহ হই নিদারুন ক্রোধের অনলে অংগার হই। ভক্তি যোগ, জ্ঞান যোগ ও কর্ম যোগ এই তিন যোগের মধ্য দিয়ে মানব মনের উন্মেষের তরে, মনের মানুষের সাথে লীন হবার জ্ঞানকে পরম সাঁইজি গুরু পরম্পরায় রক্ষা করেছেন। সাঁইজির গান নানা বাদ্যযন্ত্র অনুসঙ্গে গেয়ে, শ্রবণ করে মাথা হেলিয়ে যতই ভোলা মনের ভাবে উন্মুখ হইনা কেন, আখেরে গুরু বিনে দিশা নাই।
❝ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।।❞
গুরু অনুসারী বিনে ফকির লালন সাঁইজির পদ/গান সমুহের ‘সান্ধ্য ভাষা’ অর্থাৎ আলো-আঁধারীর ভাব অনুধাবনে আসবে না। যোনি থেকে জন্মায় জীব। মন থেকে জন্মায় মানুষ। মানুষের জন্মে তাই শুক্রানু ডিম্বানু লাগে না। মানুষের জন্ম নিতে তাই আরেকটা মানুষ লাগে। যাঁর মনের মানুষ‘র সাথে সাক্ষাৎ হইছে।ভাব, ভক্তি, প্রেম দিয়ে ‘মানুষ গুরু’ তাকে জন্ম দেন। তাই সাঁইজি বলেছেন–
❝অখন্ড মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং জগৎ চরাচর
গুরু তুমি পতিতপাবন পরম ঈশ্বর।।❞
সর্ব সাধনায় সিদ্ধ হতে মানুষ দরকার। মানুষ ভিন্ন দেবতার কাজ নহে সাধনা। সে মানুষ কেবল যোনী পথে জন্ম নিয়ে, যোনীতেই আত্মাহুতি দেয়না। সকল জীবই জন্মায় যোনীদ্বারে। কিন্তু মন ও হুশ সহকারে যে মানুষ, সে অযোনীসম্ভূতা। সে জন্মায় জ্ঞানের দ্বারে, ভক্তির পথে, প্রেমের মার্গে। সে বিভেদের চর্চায় নাই, সে নারী-পুরুষের লিঙ্গাশ্রিত নয়, সে ধনী গরীবে’র টানা পোড়নে নাই। সে মুক্ত বিহঙের মত স্বাধীন, কাম ক্রোধ লোভ ক্ষোভ হিংসা অহম নাম ষড় যন্ত্রের ক্রিয়ার রত নহে।
❝কাম করে না নাম জপে না
শুদ্ধ দেল আশেক দেওয়ানা।
তাইতে আমার সাঁই রব্বানা
মদদ সদাই।।
ধন্য আশেকজনা এ দীন দুনিয়ায়।
আশেক জোরে গগণের চাঁদ পাতালে নামায়।।❞
ফকির লালন সাঁইজির পদ/ গান সমুহে শব্দ আকারে বা ক্রিয়া-করণ আকারে হলেও, ‘মন’ এর ব্যবহার বেশি। মনরে নিয়াই তাবৎ কর্ম। কেননা-
❝আপন মনে যার গরল মাখা থাকে
যেখানে যায় সুধার আশে তথায় গরল দেখে।।❞
এই ❝মনের গুনেই মানুষ মহাজন হয়, ঠাকুর হয়ে নিত্য পূজা পায়❞
আবার এই মনই-
❝মন তুই করলি একি ইতর পনা
দুগ্ধেতে যেমন রে মিশিল চোনা❞
দুই মণ দুধে যেমন দুই ফোঁটা চোনাই যথেষ্ট নষ্ট হবার জন্য, তেমনি উপরে উপরে অনেক করলাম, ম্যালা বই পুস্তক পড়লাম অনেক অনেক ডিগ্রি নিলাম, বেশ ভূষায় ও সাধু হইলাম কিন্তু- ❝না হলে মন সরলা কি ধন মেলে কোথায় ঢুঁড়ে❞।
মনের নানাবিধ কার্য নিয়া তাই সাঁইজি বলেছেন-
❝ইতরপনা কার্য আমার ঘটে অহর্নিশি
গুরু আমারে কি রাখবেন করে চরণদাসী।।❞
গুরুমুখী, গুরুবাদী, গুরুঅনুসারী জ্ঞান অন্বেষণ কারীগণের জন্য সাঁইজি ভক্তের নিবেদন নিয়া হাজির। মহাকাজে মহাজন এই ধরায় আবির্ভূত হন বিনয় ও ভক্তির উপমা হয়ে। জ্ঞানমাত্রই গুরুপরম্পরায় প্রাপ্ত। কোরান এর সূত্র ধরে সাঁইজি গেয়েছেন-
❝যে মুর্শিদ সেইতো রসুল
তাহাতে নাই কোন ভুল খোদাও সে হয়
লালান বলে নাই এ কথা কোরানে কয়
সে কথা কোরানে কয়।।❞
মুর্শিদ বা গুরু ই হচ্ছে সেই আলো যা আপনার আমিত্বের অন্ধকার থেকে চেতনার নব চৈতন্যের উন্মেষ ঘটায়। সাঁইজি তাই গুরু কে নিবেদন করছেন-
❝গুরু তুমি তন্ত্রের তন্ত্রী
গুরু তুমি মন্ত্রে মন্তরী
গুরু তুমি যন্ত্রের যন্ত্রী
না বাজাও বাজবে কেনে।।❞
দেহ গুরুর অধীন, মন গুরুর অধীন, এবং ক্রিয়া করে যে যন্ত্র তাও গুরুর অধীন। অধীনই স্বাধীন হইবে। স্ব এর সাথে পরিচিত হইবে। ততক্ষণ, গুরু না বাজাইলে, বাজবে কেনে ?
❝জন্ম অন্ধ মন নয়ন
তুমি গুরু বৈদ্য সচেতন
অতি বিনয় করে কয় লালন
জ্ঞান অঞ্জন দাও নয়নে।।❞
গুরুপদে নিষ্ঠাবতী ফকির লালন সাঁইজি যে জ্ঞান অঞ্জন প্রাপ্ত হয়েছেন, তা আমাদের মাঝে গুরু পরম্পরায় প্রবাহিত করেছেন-
❝মুর্শিদের ঠাঁইলেনা রে তাঁর ভেদ বুঝে
এই দুনিয়ার সিনায় সিনায় কি ভেদ নবী বিলিয়েছে।।
সিনার ভেদ সিনায় সিনায়
ছফিনার ভেদ ছফিনায়
যে পথে যার মন হল ভাই
সেই সে পথে দাঁড়িয়েছে।।
কুর্তকী আর কুস্বভাবী
তারে গুপ্ত ভেদ বলেন নাই নবী
ভেদের ঘরে দিয়ে চাবি
শরা মতে বুঝিয়েছে।।
নেকতন বান্দা যত
ভেদ পেলে আউলিয়া হত
নাদানেরা শূল চাঁছিত
মনসুর তার সাবুদ আছে।।❞
কুর্তকের দোকান খোলার ইচ্ছা হল এ পথে কিছু মিলবে না, তা সুস্পষ্ট। ভাব ভক্তি পম্পরায় সাঁইজি সদা হুশিয়ারী থাকতে বলেছেন। স্মরণ করিয়েছেন-
❝চোরের সাথে খাটে না ধর্ম দ্বারা
হাতে অস্ত্র কর না হাতছাড়া।।❞
স্রেফ ভাবুকতার পোষাকে জড়িয়ে বেলা পার করার ধান্দা করতে হলে ফকিরের পথ নয়। আত্মসংস্কারের দ্বারা আত্মউন্নয়ন ও জগত সংসার ময় যে লীলা চলমান তাঁতে স্রেফ ভোগবাদী না হয়ে, ভাব-ভক্তি কে স্রেফ আচারে পরিণত করার ব্যাপারে, সাঁইজি জানিয়েছেন –
❝আসল ফকিরি মতে
বাহ্য আলাপ নাহি তাতে
চলে শুদ্ধ সহজ পথে
অবোধের চটক ভারি।।
নাম গোয়ালা কাজি ভক্ষণ
তোমার দেখি তেমনি লক্ষণ
সিরাজ সাঁই কয় অবোধ লালন
কর সাধুর খাতায় জুয়াচুরি।।❞
অবোধের চটক এড়িয়ে শুদ্ধ সহজ পথে চলার মানসে, ফকির লালন সাঁইজি সম্পর্কিত সকল কিছুই আমরা অত্র মাধ্যমে [www.lalonfakir.com] হাজির করতে চাই। দুনিয়ার সকল মানুষের সাথে ভাব-ভক্তিও ভাষা নিয়া যোগাযোগের এই সর্ববৃহৎ মাধ্যমে একীভূত হতে চাই। সেই লক্ষ্যে এই পথচলা…