সাধক কবি ফকির শীতলং শাহ

লেখক : মতিন উদ্দীন আহমদ

সাধক কবি ফকির শিতালং শাহ মতিন উদ্দীন আহমদ তাঁহার আসল নাম ছিল মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ্। তিনি ফকিরি নাম গ্রহণ করেন শিতালং। ইহা একটি ফারসি শব্দ। ইহার অর্থ পায়ের গোড়ালির গোল হাড়। নিজকে পায়ের গোড়ালির হাড়ের মত প্রকাশ করিয়া বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন আল্লাহ-রসুলের প্রেমে মাতোয়ারা সাধক ফকির কবি সলিম উল্লাহ্।

নিজের জন্ম সম্বন্ধে কবি তাঁহার ‘ছিফত পীর মুরশিদান’ পয়ারে বলিয়াছেন— 

“শিতালং নাম মোর গুনাহ্ বেশুমার

কৃপা যদি কর আল্লা করিম গফ্ফার ।

মোহাম্মদ উল্লাহ দোষগুণে মাজুর

জাঁহা বকশ্ আলী নাম পিতার মাশুর।

পরগণে চাপঘাট মোর পয়দিশ সেথায়

শ্রীগৌরী মৌজায়েতে, শিলচর কিত্তায়।”

এই শিলচর কিন্তু ভারতের কাছাড় জেলার জেলা সদর শিলচর নয়। শ্রীগৌরী মৌজার একটি পাড়ার নাম। ১৯৪৭ সালের পূর্বে চাপঘাট পরগণা সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ছিল। বিভাগান্তে, শ্রীগৌরী মৌজা সহ চাপঘাট পরগণার অর্ধেকেরও বেশি ভারতে পড়িয়া যায় এবং তখন হইতে ভারতের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছে ।

কবি তাঁহার লেখার মধ্যে কোথাও জন্ম তারিখ উল্লেখ করেন নাই। বহু অনুসন্ধানেও কিছু পাওয়া যায় নাই, যাহা হইতে সঠিক জন্ম তারিখ বাহির করা যাইতে পারে। তাঁহার মৃত্যু হয় ১২৯৬ বাংলার ১৭ই অগ্রহায়ণ। তাঁহার কবরের চারিপাশে যে দেয়াল আছে, তাহাতে তাঁহার মৃত্যু তারিখ লেখা আছে। বর্তমানে তাঁহার ছেলেদের মধ্যে কেহই বাঁচিয়া নাই, নাতিগণ আছেন। তাঁহাদের কাছে এবং পরিণত বয়স্ক মাত্র যে তিনজন মানুষ আমার অনুসন্ধানের সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। যাঁহারা শিতালং শাহকে জীবিত দেখিয়াছেন তাঁহাদের যৌবনকালে, ইহাদের কেউ-ই জন্ম তারিখ বলিতে পারেন নাই। তবে নাতিগণ বলেন যে, তাঁহারা তাঁহাদের বাপ-চাচার কাছ হইতে শুনিয়াছেন, শিতালং শাহ যখন মারা যান, তখন তাঁহার বয়স হইয়াছিল ৯০/৯৫ বছর। এই অনুমানে তাঁহার জন্ম সন ১২০১ বাংলা হইতে ১২০৬ বাংলার মধ্যে কোন এক সময় বলিয়া ধরিয়া নেওয়া যাইতে পারে।

 

শিতালং শাহর পিতা ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনিও একজন ফকির ছিলেন এবং তাঁহার ফকিরি নাম ছিল কামাল শাহ্, আসল নাম ছিল জাহা বক্‌শ আলী। ঢাকার নবাব তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি কাজের ভার দিয়া তাঁহাকে নৌকা যোগে কাছাড়ের দিকে পাঠান তাঁহার মতে কাজটি ছিল শরিয়তের বিপক্ষে। নবাবের হুকুমের অনিচ্ছায় যাইতে হইল তাই খালি আল্লাহর কাছে দোয়া করিতেন, এ বিপদ হইতে উদ্ধারের জন্য। নৌকা যখন সেই মাল লইয়া সিলেট জেলার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত শ্রীগৌরীর কাছে গিয়া পৌঁছে তখন দৈবক্রমে নৌকা ডুবিয়া যায়। আর জাঁহা বক্‌শ আলী অবাঞ্ছিত সফর হইতেই উদ্ধার পাইয়া যান। তিনি শ্রীগৌরীতেই বসবাস করিতে থাকেন, আর ঢাকায় ফিরিয়া আসেন নাই। সেখানেই তিনি বাস করিতে থাকেন, তিনি বালা মিয়ার ফুফুকে বিবাহ করেন। ঐ বিবির নাম ছিল সুরত সুরত বিবির দুই বোন ছিলেন আরস বিবি ও নিরস বিবি এবং দুই ভাই ছিলেন মীর মোহাম্মদ ও চঞ্চল মোহাম্মদ।

কবির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাইদ্বয়ের নাম রাখা হইয়াছিল আলী বকশ ও পীর বকশ। মাদ্রাসার পাঠ শেষ করিয়া তিনি যখন বাড়িতে ফিরিয়া যান, তখন নামের ভুল অর্থ দেখিয়া ভাইদের নাম আলিম মিয়া ও পিরু মিয়া করিয়া দেন ।

বর্তমানে সাধক কবির পুত্রগণের কেহই বাঁচিয়া নাই। তাঁহার নাতি জনাব মাহমদ আলী সাহেবের কাছ হইতে অনেক লোয়াজিমা পাইয়াছি এবং তাঁহার জিম্মায় সিলেটী নাগরীতে লেখা একমাত্র মূল বই আছে, যাহাতে কবির প্রায় সম্পূর্ণ রচনা আছে, তাহা হইতে আমরা বাংলা হরফে নকল করিয়া আনিয়াছি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই একমাত্র ভুল বিহীন মূল বইয়েরও কয়েকটি পাতা কোন সময়ে কোন অতিভক্ত চুরি করিয়া নিয়া গিয়াছেন, তাহা চিরতরে লোপ হইয়া গেল। কবির জীবদ্দশায়ও কয়েকটি পাতা হারাইয়া যায়, তাহা কবির কাছে গোপন রাখা হয়। সেইগুলিও লোপ হইয়া গেল। কেউ জানেনা সেই সব পাতায় কি অমূল্য বাণী ছিল ।

শাহ সাহেব নাকি অছি করিয়া গিয়াছিলেন যে তাঁহার লেখা যেন ছাপা করা না হয়। একবার এক ভদ্রলোক [বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার মধুপুর নিবাসী তৎকালীন করিমগঞ্জ থানার সাব ইন্সপেক্টর অব স্কুল্স মরহুম সৈয়দ মুরতাজা আলী] ছাপা করিতে গেলে পর শাহ সাহেবের উত্তরাধিকারীগণ আদালতের আশ্রয়ে তাহা বন্ধ করিয়া দেন। এখন অবশ্য তাহা ছাপাইতে আইনগত কোন বাধা নাই। না ছাপানোর জন্য কবির এই মহা- অবদানের খবর অনেকেই জানেন না, আর স্থানীয় গায়কেরাও শুধু গানগুলিই নকল করিয়া নেন, তারও সব সময়, কবিতা অংশ মোটেই নকল করা হয় না। তার উপর কবি যে সমস্ত আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন, গ্রামের নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত গায়কগণ সেগুলির শুদ্ধ উচ্চারণ করিতে সক্ষম না হওয়ায়, তদপরিবর্তে নিজের ইচ্ছামত সহজ এক প্রতিশব্দ ব্যবহার করিয়া গান গাহিয়া যান, এ কারণে মূল ভাব ও অর্থ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হওয়া যায়।

কবির নিজের হাতে লেখা যে খাতা ছিল, অতিভক্তগণ তাবিজ রূপে ব্যবহার করার জন্য তাহার বেশির ভাগ চুরি করিয়া নিয়া গিয়াছিল। সামান্য কয়েক পৃষ্ঠা মাত্র কবির নাতি আহমদ আলীর কাছে আছে। তিনি তাহা হাতছাড়া করিতে চাহেন না, বিশেষ অনুরোধে অস্থায়ী ভাবে তিনি সেই পৃষ্ঠাগুলি আমাকে ধার দিয়াছেন। আমার অনুরোধে ঢাকা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি সেগুলির Microfilm করিয়া রাখিয়াছেন।

আলী প্রথম পুত্রের (সলিম উল্লাহর) জন্মের পর, তাঁহার শিশু বয়সেই, জাঁহা বক্‌স শ্রীগৌরীর বাড়ি ছাড়িয়া, আরো মাইল নয়/দশ পূর্বদিকে, আদত কাছাড় জেলার তারিণীপুর গ্রামে গিয়া বাস করিতে থাকেন, সেখানে তাঁহার অন্যান্য পুত্রদের জন্ম হয়। সলিম উল্লাহর বয়স যখন শিক্ষালাভ করার মত হয়, তখন তিনি সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে চলিয়া যান। সিলেট শহরের দশ মাইল পূর্বে বিখ্যাত ফুলবাড়ি গ্রাম। এককালে এই ফুলবাড়ি ছিল ইসলামি শিক্ষার সুবিখ্যাত এবং উচ্চস্তরের শিক্ষা কেন্দ্র। তখনকার দিনে বাংলা শিক্ষার জন্যও সু- বন্দোবস্ত ছিল। মাদ্রাসা যেমন ছিল, তেমনি ছাত্রবৃত্তি স্কুলও ছিল। মাদ্রাসায় উলামাগণ শুধু মাদ্রাসার শিক্ষাই দান করিতেন না, আধ্যাত্মিক জ্ঞানে শিক্ষা দেয়ার মত, কাবেল, কামেল, আলেমও তখন ফুলবাড়িতে বর্তমান ছিলেন। তখনকার দিনে ছাত্রবৃত্তি স্কুলগুলিতে শিক্ষার মান বেশ উচ্চ পর্যায়ের ছিল। ছাত্রবৃত্তি পাস ছাত্রগণের বাংলা ভাষা ও বাংলা ব্যাকরণে বেশ জ্ঞান লাভ হইত। শ্রীগৌরীর পাশের মৌজা নাহারপুর। নাহারপুরের মোল্লা মদরিছ আলী, এখন (১৯৬৫ইং) তাঁহার বয়স আশির উপরে। তিনি শিতালং শাহ সম্বন্ধে অনেক খবর রাখেন। শিতালং শাহ শেষ জীবনে বারঠাকুরী মৌজার কাশিরচর পাড়ায় বাস করিতেন এবং সেখানেই তাঁহার কবর আছে। নাহারপুর হইতে কাশিরচর ও দুই মাইল দূরে। এই মদরিছ আলী সাহেব বলিয়াছেন যে শিতালং শাহ (সলিম উল্লাহ) ফুলবাড়িতে মাদ্রাসা পাশের সঙ্গে সঙ্গে, ছাত্রবৃত্তি স্কুলের শেষ পরীক্ষাও পাশ করিয়াছিলেন।

সলিম উল্লাহ তদুপরি ফুলবাড়িতে আধ্যাত্মিক দিকেও সবক গ্রহণ করেন। কবি এই প্রসঙ্গে তাঁহার এক পয়ারে বলিয়াছেন—

“শাহ্ আবদুল আলী মোর পীর দস্তগীর

হাশিল মুরাদ ওলী বাতিনে জাহির ।

মুর্শিদ কামিল মোর শাহ আবদুল ওহাব

তিনির প্রসাদে হৈল ধিয়ানেতে লাভ।”

আরেক জায়গায় বলিয়াছেন—

“দ্বিতীয় মুর্শিদ মোর শাহ্ আবদুল কাহির

শিশুকালে কেরামতি আছয়ে জাহির।”

আরেক জায়গায় লিখিয়াছেন—

 “এই দুই সাহেব পীর মুর্শিদ কামিল 

কৃপায়ে রব্বানী এতে মুরাদ হাসিল।”

আরেক জায়গায়

“এই দুই সাহেবে মোরে রাখিয়া কৃপায়

ভেদ মৰ্ম শিক্ষা দিলা তওঞ্জু নির্ঘায়।”

এই দুই সাহেব সত্য সত্যই অনেক উঁচু দরজার আলেম ও কামেল ছিলেন। সলিম উল্লাহ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন বলিয়া, তখনকার দিনের Syllabus (পাঠ্যতালিকা) মতে তাঁহাকেও ফারসি পড়িতে হইয়াছিল। আরবি তো পড়িয়াছিলেন যথারীতি, এর উপর ছাত্রবৃত্তি স্কুলে বাংলা পড়ার ফলে, তাঁহার রচনায় আমরা আরবি ফারসি এবং কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহারের দৃষ্টান্তই শুধু দেখিতে পাইনা, আমরা সেগুলির স্বচ্ছল, সুন্দর প্রকাশভঙ্গিও দেখিতে পাই, আরো দেখিতে পাই বহু আঞ্চলিক শব্দের অনুপম সংমিশ্রণ। এইভাবে নানা বর্ণের ও নানা জাতের ফুল দিয়া কবি তাহার কাব্যমালা গাঁথিয়া এক অভিনব সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিয়াছেন।

মারিফতি জ্ঞানের সঙ্গে সাধকের পরিচয় যে কতো গভীরভাবে হইয়াছিল, তাহা তাঁহার মারিফতি সাধনা সম্পর্কিত রচনায় ব্যবহৃত ভিন্ন ভিন্ন স্তরের বর্ণনা হইতে বুঝা যায়। হিন্দু সাধন পদ্ধতিতেও যে তিনি প্রগাঢ় জ্ঞান ধারণ করিতেন, তাহারও প্রচুর প্রমাণ তাঁহার রচনায় রহিয়াছে। তাঁহার রচনায় কোরান হাদিস ছাড়াও বহু কিতাবের বরাত দেয়া আছে, ইহা হইতে বুঝা যায় তাঁহার পড়াশুনাও বিস্তর ছিল। কোন কোন গানে ও কবিতায় হুবহু কোরান হাদিসের বাণীরই পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন।

ফুলবাড়িতে সকল রকম শিক্ষা শেষ হইলে পর, তিনি তারিণীপুরের বাড়িতে চলিয়া আসেন এবং পিতার সঙ্গে চাষাবাদের কাজে লাগিয়া যান। কিন্তু ফুলবাড়িতে থাকার সময় তাঁহার মুর্শিদ তাঁহার মনে ফকিরির যে বীজ বুনিয়া দিয়াছিলেন, তাহা অঙ্কুরিত হইতে শুরু করে। ক্রমে অবস্থা এমন হইয়া উঠিল যে, তিনি আর তাঁর নিজকে সামলাইয়া রাখিতে পারিলেন না, মনের ডাক ঘরের টানকে হারাইয়া দিল। একদিন যখন মাঠে হাল চাষ করিতে ছিলেন, তখন কাহাকেও কিছু না বলিয়া, লাঙ্গল আর গরু সেখানে ফেলিয়া পা উঠাইলেন পূর্বদিকে যাওয়ার পথে, আর চলিতে চলিতে গিয়া পৌঁছাইলেন কাছাড় ও মণিপুর সীমান্তে অবস্থিত ভুবন পাহাড়ে। ভুবন পাহাড় কাছাড় জেলার পূর্ব দক্ষিণ সীমান্তে কাছাড়ের ভিতরে অবস্থিত, তাহার পূর্বে-ই মণিপুর রাজ্য। নির্জন স্থানে বাস করিয়া, ফকিরি এবাদত জপতপ করিবার মানসে, স্বেচ্ছায় বনবাস জীবন গ্রহণ করিলেন। তিনি সুদীর্ঘকাল বনে বাস করিয়াছেন। কেহ কেহ বলেন বারো বছর, কেহ কেহ বলেন বারো বছরের চেয়ে কিছু কম।

একটা জিনিস দেখা যায়, রামায়ণের রাম-ই শুধু বনে বাস করিয়াছিলেন চৌদ্দ বছর, কিন্তু ফকির সন্ন্যাসীগণের বেলায় প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায় “বারো বছর বনবাসী ছিলেন।” জানিনা ফকিরি মাদ্দায় বারো বছর মেয়াদী কোন তরিকা আছে কি না।

শিতালং শাহ্র বেলায় ইহা ধরিয়া নেয়া যায় যে, তিনি বহুদিন ব্যাপী বনে জঙ্গলে জপ- তপে, আরাধনা এবাদতে কাটাইয়াছিলেন। বনবাস যুগে যে তাঁহার সুদীর্ঘ বারো বছর কিম্বা কিছু কম, বেশি সময় কাটিয়াছিল, তাহা তাঁহার যাত্রাপথের শুরু স্থান হইতে আবার লোকালয়ে আসিয়া উপস্থিত হওয়ার স্থান পর্যন্ত, পথের দৈর্ঘ্য হইতে অনুধাবন করা যায়।

সাধক শিতালং ভুবন পাহাড়ে গিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করেন। তারপর কাছাড় জেলার পূর্ব সীমানা বাহিয়া বাহিয়া, জঙ্গলে উত্তরমুখী হইয়া অনেক দূর পর্যন্ত যান। তখন পশ্চিমমুখী হইয়া পাহাড়ে চলিতে চলিতে, সিলেট জেলার উত্তর দিকস্থ জৈন্তিয়া পাহাড়ের ভিতর দিয়া সিলেটের উত্তর-পশ্চিম মহকুমা (বর্তমান জেলা) সুনামগঞ্জের উত্তরদিকস্থ লাউড় পাহাড় পর্যন্ত গিয়া তাঁহার জঙ্গল ভ্রমণ খণ্ড শেষ করেন। এখানে তিনি এমন এক জায়গায় কিছুদিন —বনবাস খণ্ডে একেবারে শেষের দিকে কাটাইয়াছিলেন, সেখান হইতে লোকালয় বেশি দূরে ছিল না এবং লোকালয়ের ২/১ জন লোকের সঙ্গেও সেখানে মাঝে মাঝে তাঁহার দেখা সাক্ষাৎ হইত।

প্রসঙ্গত, তাঁহার বনবাস যাওয়ার বেশ কিছু দিন পরে, তিনি একরাতে তারিণীপুরের বাড়িতে আসিয়া তাঁহার মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়া, সেই রাত্রেই আবার ফিরিয়া গিয়াছিলেন। ইহার বহু বছর পরে, যখন বনবাস জীবন শেষ করিয়া আবার লোকালয়ে বাস শুরু করেন, তখন দেখিতে পান যে ইহার বহু পূর্বেই তাঁহার মা মারা গিয়াছেন। যখন মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা করিতে আসেন এবং সঙ্গে সঙ্গে-ই আবার চলিয়া যান তখন তিনি তারিণীপুর হইতে কাছাকাছি কোন জঙ্গলবাসী ছিলেন। কিন্তু যেখানে আসিয়া লোকালয়ের সঙ্গে আবার যোগ স্থাপন করেন, সে স্থান তারিণীপুর হইতে একশ মাইলের চেয়ে বেশি দূরে। তাছাড়া, তিনি ভূপর্যটকের মত খালি মাইলের পর মাইল হাঁটিয়া চলেন নাই, শুধু পথের পর পথ ধরিয়া হাঁটেন নাই, তিনি সাধন-ভজন, এবাদত-আরাধনা, জপ-তপ মাহতাজ ও ধ্যান-যোগ অভ্যাসও করিয়াছিলেন এবং এই সব কাজ করিতে সুদীর্ঘকাল স্থিতি অবস্থায় থাকিয়া চিত্তের একাগ্রতা সঞ্চয় করা একান্ত প্রয়োজনীয়। সুতরাং সময় সাপেক্ষ।

তিনি শরিয়তের পূর্ণ পাবন্দ ছিলেন, তাঁহার রচনায় এবং জীবনের চলার পথে তাহা পূর্ণ ভাবে প্রমাণিত। তিনি আধ্যাত্মিক সাধনাও করিয়াছিলেন ইসলামি কানুন মতে। তাঁহার রচনায় বহুবার রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার উল্লেখ দেখা যায়। তাহা দেখিয়া মনে হয় যে রাধার বিরহ অনলের ও প্রেম নিবেদনের এবং ভাবাবেগে রূপকের অন্তরালে যে নিগূঢ় গভীর আধ্যাত্মিকতা রহিয়াছে, তাহা সাধক কবি পূর্ণভাবে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার অল্প বয়সে ফুলবাড়িতে পাঠ্যাবস্থায় সেখানকার খুব গোঁড়া ইসলামি ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবেশে রূপকের মোহজাল ভঙ্গ করিয়া, বৈষ্ণব ভাবাবেগের একেবারে অন্তরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা সেখানে থাকার কোন সম্ভাবনাই নাই বা তাঁহার গ্রাম তারিণীপুরে তো তাহা অকল্পনীয়। অথচ কবির রচনায় তাহা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

ইহা হইতে অনুমান করা যায় যে, ছাত্রবৃত্তি স্কুলে পড়ার সময়, হয়ত সংসামান্য ভাবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার নিগূঢ় আধ্যাত্মিক অর্থের সঙ্গে তাঁহার পরিচয় হইলেও হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু তাহা ফুলবাড়িতে না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। পরে অপরের সাহায্যেই হউক কিম্বা তাহার নিজের গবেষণা ও প্রচেষ্টাই-ই হউক, তিনি এই প্রেমলীলার আধ্যাত্মিক রূপের রস গ্রহণ করিতে পারিয়াছিলেন। তিনি রূপককে মুছিয়া ফেলিয়া দিয়া, সত্যিকার সত্যের সন্ধান পাইয়াছিলেন, আর নিজের প্রেমাস্পদ আল্লাহর প্রেমে পাগল পারা হইয়া উঠিয়াছিলেন সময় সময় প্রেমাষ্পদের নৈকট্য ক্ষণিকের তরে পাইয়া, বিরহে জরজর হইয়া আবার সেই নৈকট্য লাভের জন্য আকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মুশিদ আব্দুল ওহয়াবকে অনুসরণ করেছিলেন।

ভুবন পাহাড়ের চূড়ায় এখনও এক অতি প্রাচীন শিব মন্দির আছে। সেখানে প্রতি বছর শিব চতুর্দশীর সময় বিরাট মেলা বসে। (একদা এক শিব চতুর্দশীর মেলার সময় সরকারি কার্যোপলক্ষে লেখকের সেখানে যাওয়া হইয়াছিল।) এমনিতেই সেই মন্দিরে সাধু সন্ন্যাসীগণ বাস করেন, শিব চতুর্দশীর সময় আরো বহু সাধু-সন্ন্যাসী এবং সাধু সন্ন্যাসীবেশী লোক আর মানত আদায়কারী হিন্দুগণ ভুবন মন্দিরে গিয়া উপস্থিত হন। এই রকম চলিয়া আসিতেছে স্মরণ পূর্বকাল হইতে। শিতালং শাহ্ যখন ভুবন পাহাড়ে গিয়া উঠেন তখন সাধু সন্ন্যাসীগণের সঙ্গে সেখানে তাঁহার যোগাযোগ হইয়াছিল, ইহা সহজেই ধরিয়া নিতে পারা যায়। তিনি যখন সেখানে গিয়া উপস্থিত হন, তখন যদি মেলার মওসুম না-ও হইয়া থাকে তবুও মন্দিরে বাসকারী সন্ন্যাসীগণের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হইয়াছিল। মেলার মওসুম হইলে তো আরো বড়দলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। এই সুপ্রাচীন মন্দিরের অবস্থিতি হইতেই বুঝা যায় যে, ঐ পাহাড় ও নিকটবর্তী জঙ্গল সাধু সন্ন্যাসীগণ কর্তৃক অধ্যুষিত ছিল।

ভুবন পাহাড়ের মন্দিরস্থ সাধু সন্ন্যাসীগণ ছাড়াও অন্যান্য সন্ন্যাসীগণের সঙ্গেও তাঁহার দেখা সাক্ষাৎ যোগাযোগ ও ভাবের আদান প্রদান যে হইয়াছিল এবং একে অন্যের সাধনার পন্থা নিয়া আলোচনা ও মতের আদান প্রদান যে হইয়াছিল, তাহার পরিচয় আমরা সাধকের রচনাবলীর বহুস্থানে দেখিতে পাই। তিনি সাধনার এমন সব প্রক্রিয়ার উল্লেখ করিয়াছেন, যেগুলি হিন্দু যোগীগণ-ই অবলম্বন করিয়া থাকেন। তাহা ছাড়া তিনি হিন্দু সাধকগণের মত, কোন কোন সময় নিজকে নারীরূপে কল্পনা করিয়া আল্লাহকে নররূপে কল্পনা করিয়াছেন আবার অন্য সময়ে নিজকে রাধিকারূপে কল্পনা করিয়া আল্লাহকে কৃষ্ণরূপে কল্পনা করিয়াছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ—

“প্রেম রসে প্রেম সিন্ধু সান্তারে করে লংঘন

মর্দন তরঙ্গে ভাসি দিবে আসি দরশন।

প্রেমানলে উদাসিনী প্রিয় বিনে দহে মন।

বিচ্ছেদের তীক্ষ্ণ শরে দেহা জ্বলে অনেক্ষণ।”

আর—

“শিতালঙ্গে কহে প্রাণেতে না সহে বিরহেতে সন্ন্যাসিনী

পন্থহারা হইয়া ডাকি প্রিয়া প্রিয়া

আইস প্রিয়া গুণমনি গো অধীতী রাই।” ইত্যাদি।

তিনি ফকিরহইয়াও গৃহী ছিলেন, সংসারী ছিলেন, শরিয়তের অত্যন্ত বেশি অনুগত ছিলেন, সালিক ছিলেন, সন্ন্যাসী ছিলেন না। আল্লাহর প্রেমে পাগল পারা ছিলেন, তাই শরিয়ত অনুযায়ী এবাদত করিয়া তাঁহার পিয়াস মিটিত না। তিনি ইহাও উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে শরিয়তের বরখেলাফ চলিয়া মারিফত লাভ হয় না। যে পিয়াস তাঁর প্রাণে পয়দা হইয়াছিল, তাহা শুধু নামাজ রোজাতে তৃপ্তি আনিয়া দিতে পারিত না, তাঁহার চাওয়া ছিল আরো অনেক উচ্চ স্তরের জিনিস পাওয়ার জন্য, আল্লাহর কুদরত ও দিদার। তিনি শুধু নিজে শরিয়তের পাবন্দ ছিলেন না, তিনি এই কথাও উপলব্ধি করিতেন যে শরিয়তের বরখেলাফ চলিয়া মারিফত লাভ হইবার নয়। শরিয়তের নিয়ম মানিয়া চলিবার জন্য তিনি বারে বারে নামাজ রোজার তাগিদ দিয়াছেন তাঁহার লেখার মাধ্যমে।………

আল্লাহ্র প্রেমে পাগল সাধক শিতালং শাহ্ দুঃখ করিয়া বলিতেছেন, নামাজ পড়িয়াও তাঁহার মন তাহাতে মজিল না, তিনি চাহেন আল্লাহ্র প্রেম, তাই শুধু নামাজে সেই নিদারুণ পিয়াস মিটিল না।

নামাজ পড়ার জন্য কবি বহু পয়ারে ও বহু গানে খুব জোরের সঙ্গে তাগিদ দিয়াছেন, নানা তালে নামাজের গুণগান করিয়াছেন। ‘রাগ হকিকতনমাজ গানে কবি বলিতেছেন— 

“গুণের সীমা নাই, নমাজেতে ভাই

মুশকিল তরিতে তরে, ও মনা ভাই, নামাজেতে ঠাই রে।

গুণের সীমা নাই ।

তকবির তহরিমা যবে করিবে স্মরণ

অঙ্গে যত পাপ তর রে, ও মনা ভাই

হইবে মোচন রে।

শিতালং ফকিরে মাঙ্গে কৃপা এলাহির ।

নমাজেতে চিত মোর রে, ও মনা ভাই,

থাকিতে হাজির রে।

ফকির শিতালং তাঁহার বনবাস যুগের শেষের দিকে-সুনামগঞ্জের উত্তরাঞ্চলে বসতি এলাকা হইতে দূরে, লাউড়ের পাহাড়ের প্রান্তে আসিয়া এক জায়গায় বাস করিতেন। গ্রামের একজন লোক সেই জঙ্গলের কাছে এক বিলে ছোট ছোট মাছ ধরিতে যাইত। জঙ্গলবাসী ফকিরকে সে রোজরোজ কিছু দুধ নিয়া দিত। কিছুদিন পরে সে ফকিরকে তাঁহার নাম ধাম জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে তাঁহার নাম সলিম উল্লাহ ছিল, ফকিরি নাম শিতালং, বাড়ি সিলেট জেলার তারিণীপুর গ্রামে ।

শিতালং শাহ্ তাঁহার নেক আমলের জন্য এবং দীর্ঘদিন ধরিয়া এবাদত, আরাধনা ও সাধনা করিয়া এমন কিছু একটা লাভ করিয়াছিলেন, যাহার জন্য লোকে তাঁহার প্রতি এত বেশি শ্রদ্ধাশীল ছিল। তাঁহার অনাবিল ও নির্লোভ চরিত্রের জন্য, মানুষকে সদা সর্বদা শরিয়ত মতে চলার তাগিদ দিয়ার জন্য এবং সর্বোপরি কোন মানুষের কাছ হইতে কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করিয়া, শুধু নিয়া যাওয়ার মনোভাবের জন্য, মানুষ তাঁহার সাহায্যে, এমন কি স্মরণেও মুগ্ধ হইয়া যাইতেন। তাঁহার সম্বন্ধে অলৌকিক কাহিনীগুলি পাশে রাখিয়া দিয়া ও তাঁহার আমল আখলাক ও চরিত্র গুণে তিনি এমন ধারা শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকারী হইতে পারিয়াছিলেন।

এখানে সিলেটি নাগরি সম্বন্ধে একটু আলোচনা করিতে চাই। শিতালং শাহ্রর সময়ে এবং এর পরেও এই অঞ্চলে সিলেটি নাগরি হরফে শিতালংগি গানসহ যত পির মুর্শিদি গান লেখা হইত, তাহাও সিলেটি নাগরিতে। জঙ্গনামা, হালতুন্নবি এবং আরো আরো বহু পুথি সিলেটি নাগরিতে ছাপা হইত। সিলেট শহরে তেমন একখানা ছাপাখানাও ছিল। এবং এতে সেখান হইতে ‘সিলেটি নাগরি হিখানামক একখানা পুস্তিকাও বাহির হয়। দেব নাগরি অক্ষরগুলিকে সহজতর করিয়া নিয়া এই সিলটি নাগরির অক্ষরগুলি এবং যুক্তাক্ষর প্রায় সম্পূর্ণ বর্জিত। শিখিতে অতি সহজ এবং লিখিতেও তেমনি সহজ। যদিও দেব নাগরি অক্ষর হইতে সেগুলি গৃহীত, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় কোন সিলেটি হিন্দু ইহার চর্চা করিতেন না। ইহার কারণ বোধ হয়, সিলেটি নাগরিতে লেখা যতগুলি পুথি পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের সবগুলিই মুসলমানী বিষয়াদি নিয়া লেখা এই জন্য হিন্দুগণ দুনিয়াদারি কাজের জন্য বাংলা শিখিয়া নিয়া তাহাকেই যথেষ্ট মনে করিয়া, সিলেটি নাগরির দিকে পিঠ ফিরাইয়া দিয়াছিলেন।

কালের প্রভাবে এবং জীবন সংগ্রাম কঠোরতর হইয়া উঠায় গ্রামাঞ্চলে পুথি পাঠের চর্চা আগের চেয়ে অনেক কমিয়া যাওয়ায়, সিলেটি নাগরিও প্রায় বাদ পড়িয়া যাইতেছে। তবে পূব সিলেটে এখনো অনেক বৃদ্ধ আছেন, যারা কোন দলিল দস্তাবিজে নিজের নাম সিলেটি নাগরিতেই লিখেন, বাংলা শিখেন নাই বলিয়া।

শিতালংগি গীতির চর্চা এখনো পূর্ব সিলেটে প্রচুর এবং মূল বই সিলেটি নাগরিতে লেখা বলিয়া যাহারা নকল করিয়া আনেন, তাহারা সিলেটি নাগরিতেই নকল করেন। এই জন্য বলা যায় যে, পূর্ব সিলেট অঞ্চলে শিতালং শাহ্ এবং অন্যান্য মরমী কবিদের গানের চর্চার মাধ্যমে সিলেটি নাগরির সলিতা এখনো টিম টিম করিয়া জ্বলিতে আছে।

এখনো ঐ অঞ্চলে মাঝে মাঝে শিতালংগি গানের বৈঠক বসে এবং এই সব বৈঠকে যে সব গায়ক তাহাদের গানের খাতা নিয়া আসেন, সেই সব খাতা সিলেটি নাগরিতেই লেখা।

প্রসঙ্গত বলিয়া নেই যে, এই সব গায়কদলের কাহারো কাছেই শীতালংগি সব গান লেখা নাই, যিনি যে কয়েকটি গাইতে পারেন, শুধু সেইগুলিই লেখা। গান ছাড়া পয়ার কিম্বা ত্রিপদী ছন্দে রচিত কবিতাই এই গায়কদল লিখিয়া রাখেন না।

আজকাল পুথি পড়ায় বৈঠক বসাইবার মত মানসিক অবস্থা মানুষের নাই। জীবন – সংগ্রামে সকলেই সাধ্যানুসারে ব্যস্ত, অর্থনৈতিক কারণে মনের সেই দিকের উৎস এক রকম শুকাইয়া গিয়াছে বলিলেও চলে। সেই কারণে, বিশেষ করিয়া শিতালঙ্গি গানের জন্য-ই (সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য অন্যান্য মারিফতি মুর্শিদি গানও আছে বটে) এই অঞ্চলে এখনো সিলেটি নাগরি ধুকধুক বুক লইয়া কোনমতে বাঁচিয়া আছে, নইলে কবেই বাংলা হরফের কাছে সে হার মানিয়া বিস্মৃতির গহ্বরে বিলীন হইয়া যাইত।

আরো একটি কথা উল্লেখ করিয়া শিতালং শাহ্-র জীবন সম্বন্ধে অতি সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা শেষ করিব।

অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, তাঁহার পুত্রগণ বাঁচিয়া থাকিতে এবং তাঁহাদের মৃত্যুর পরও তাঁহাদের পুত্রগণ এবং অসংখ্য ভক্তগণ বাঁচিয়া থাকা সত্বেও তাঁহাদের উত্তরাধিকারীগণ, তাঁহার মৃত্যু তারিখকে উপলক্ষ করিয়া, মৃত বোজর্গকে রোজগারের জন্য তেজারতির একটা মাল হিসাবে ব্যবহার করিয়া, কারবারটিকে “উ” নাম দিয়া প্রত্যেক বছর ভক্তগণের কাছ হইতে আয়কর মুক্ত অর্থ আদায় করেন না, এবং ঐ তারিখে কোন ফকির মেলাও বসান না।

আল্লাহ্র রসুলের প্রতি তাঁহার প্রেমের পিয়াস, সে পিয়াস মিটেনা বলিয়া তাঁহার নিদারুণ হাহুতাশ, করুণ ক্রন্দন, প্রেমের আগুনে প্রাণ জ্বলিয়া জ্বলিয়া বে-করার হইয়া উঠা, আবার কোন কোন সময় মাশুকের কিছুটা নৈকট্য উপলব্ধি করার পর আবার বিরহের যন্ত্রণায় জরজর, আঁধার হইতে ক্ষণিকের জন্য আলোতে আসিয়া আবার আঁধারে গিয়া পড়িলে যেমন আঁধার বেশি করিয়া গাঢ় হইয়া উঠে, তেমনি কোন সময় নৈকট্যের অনুভূতি লাভের পর আবার যখন বিরহ বেদনা শুরু হয়, সেই বেদনা তখন হয় আরো দুঃসহ, আরো মর্মান্তিক, আরো কষ্টকর। মৃত্যুর দুয়ার পার হইয়া রসূলুল্লাহ্ সা.’র সুপারিশে ‘মোকান-হীন—মোকামে (শিতালং শাহ্র ভাষায়- মোকানে লা মোকাম‘) পৌছিয়া গিয়া পরমাত্মার মাঝে লীন হইয়া গিয়া চির মিলনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা নানা ভাবে এমন সব উচ্চাঙ্গের ভাব প্রকাশ করিয়া, আর মানবকুলকে পরকালের জন্য ইহকাল হইতে প্রস্তুতি নিবার জন্য আল্লাহ রসূলের এশকে আশেক কবি, সাধক কবি, যে অমর বাণী রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাই তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিয়াছে। ভবিষ্যতেও রাখিবে। তাঁহার স্মৃতি বজায় রাখার জন্য, বছরে একবার ভক্তদের দান করা গরু-বকরি জবেহ্ করিয়া “উ” নামে খানাপিনা করার, আর টাকা পয়সা রোজগার করার কোন প্রয়োজন নাই।

আল্লাহ্ তাঁহার রুহের মাগফিরাত করুন, তাঁহাকে তাঁহার সাধনোচিত মোকামে পৌছাইয়া দিন। আ-মীন ।

 

দ্র. “ 

বইঃমরমী কবি শিতালং শাহ

সংকলন ও সম্পাদনা নন্দনাল শর্ম

প্রকাশ : পৌষ ১৪১২/ ডিসেম্বর/২০০৫

গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ

বাংলা একাডেমী, ঢাকা-১০০০

শেয়ার করুন:

অন্যান্য পোস্ট

আরশি নগর কেমন শহর ? বিষয় ফ্রয়েডের আবিষ্কার ও মহাত্মা লালন ফকির | সলিমুল্লাহ খান

এই লেখার বিষয় মহাত্মা লালন ফকির। তবে মালিকের অনুমতি পাই তো প্রথমে বন্দনা করি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ

বিস্তারিত

ফ কি র লা ল ন শা হ | ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালন শাহ ফকিরের কুড়িটি গান সর্বপ্রথম ‘প্রবাসী’র ‘হারামণি’ শীর্ষক বিভাগে প্রকাশিত হয় (প্রবাসী, ১৩২২, আশ্বিন-মাঘ সংখ্যা)। ইহার পূর্বে লালনের

বিস্তারিত

You cannot copy content of this page