এই লেখার বিষয় মহাত্মা লালন ফকির। তবে মালিকের অনুমতি পাই তো প্রথমে বন্দনা করি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সন্জীদা খাতুন একদিন মনের দুঃখে লিখেছিলেন:
উনিশ শ একষট্টিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর বিশ্বব্যাপী আয়োজন এদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রীতি পুনরুজ্জীবিত করল । এ সময়ে বাধা অগ্রাহ্য করেও ঐতিহ্য রক্ষা করার অকৃত্রিম (sic) আগ্রহ লক্ষিত হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর যে শ্রোতৃসমাবেশ তাও সর্বসাধারণের সমাবেশ নয় – 1 —শিক্ষিতজনেরই সমাবেশ। কাজেই এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে আমাদের দেশেও শতবর্ষের রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধারণ সঙ্গীত হতে পারল না। (খাতুন ১৯৯৪: ২৭)
কিন্তু কেন? জবাবে সন্জীদা খাতুন যা লিখেছেন তা – আমার বিবেচনায় – সাধারণের কৌতূহল মেটাতে পারে। আমি তাই – যতদূর রচনার কলেবর বড় না করে পারি – সন্জীদার জবানি শুনব। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত‘, সন্জীদা লিখেছেন:
বাংলা গানের সাগরপ্রবাহে মিলিত একটি বহু শাখাবিশিষ্ট স্রোতস্বিনী। বাঙলাদেশের উচ্চাঙ্গ ও লোকসঙ্গীত এবং আংশিকভাবে পুরনো বাংলা গান থেকে উপযোগী রস গ্রহণ করে আপন প্রকৃতি অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীতের ভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। বিশেষ করে সুরের দিক থেকে বিচার করলে এই কথা দাঁড়ায়।
‘তাহলে‘ – সন্জীদা জিজ্ঞেস করছেন – ‘এই বাংলাদেশেরই সুর ছেনে যে সুরলোকের সৃষ্টি তার সঙ্গে সাধারণের যোগটা বিচ্ছিন্ন হল কিসে?’ (খাতুন ১৯৯৪: ২৮) একইসঙ্গে সন্জীদা খাতুন মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ‘বাণীর দিক থেকেও বাঙালী সংস্কৃতির সন্তান।’ ‘রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী সাধারণের চিত্তে সাড়া জাগাতে পারছে না কেন‘, সন্জীদা অকপটে কবুল করেন, “তা, বিস্ময়ের কথা বটে।‘ বিস্মিত প্রফেসরের জিজ্ঞাসা:
কিন্তু বাউল গানের বাণীর রহস্যময়তা যে দেশের সাধারণ মানুষের চিত্ত স্পর্শ করেছে— কীর্তনের ভাবাবেগে যে সাধারণ চিত্তকে উদ্বেলিত করেছে – রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে সেই চিত্তের জড়তা কি সত্যিই স্বাভাবিক ব্যাপার? এর পেছনে গভীরতর কারণ নিহিত নেই? (খাতুন ১৯৯৪: ২৮)
‘গভীরতর কারণ’– ভাগ্যের বিষয় – সন্জীদা খাতুন জানিয়েছেন আমাদের। তাঁর মতে, সাধারণভাবে সঙ্গীতমুগ্ধ শ্রোতা বা বিশেষ কোন ধারার সঙ্গীতরসিকের পক্ষেও রবীন্দ্রসঙ্গীত-রসোপলব্ধির জন্য ভিন্ন ধরনের চেতনা প্রয়োজন । সেই চেতনার অভাবই – এই প্রখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞের মতে চ—সাধারণ মানুষের চিত্তের জড়তার পিছনে নিহিত গভীরতর কারণ।
এই কারণের দুই ভাগ বিবেচনায় নিয়েছেন সন্জীদা খাতুন। এক নম্বরে সুর । দুই নম্বরে বাণী । তিনি বিশদ করেছেন:
লোকসঙ্গীত বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রচয়িতা একজন নন। ভিন্ন ভিন্ন জনের সৃষ্টি হয়েও সেইসব সঙ্গীত আপন বিশেষ ধারার সঙ্গীতরূপেই স্বীকৃত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে অবস্থাটি সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, এই বেলা বিভিন্ন শ্রেণীর বা ধারার সুর একজনের হাতে এমন বিশেষ একটি অবয়ব পাচ্ছে – যাতে সেই একজনের সৃষ্টি বলে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে । (খাতুন ১৯৯৪: ২৮)
তারপর আসে গানের বাণী । সন্জীদার বিশ্বাস:
বাউল বা কীর্তন গানের ভাব এদেশে বহুদিন ধরে প্রচলিত সুপরিচিত ভাব। তার মর্মগ্রহণের জন্য নতুন চিন্তা বা বোধশক্তির প্রয়োজন নেই । এবং যত গীতকারই বাউল বা কীর্তন রচনা করুন না কেন — গানের ভাব সেই এক চিরপুরাতন। অথচ, রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় তাঁর শিক্ষিত ও কর্ষিত চিন্তা ও বোধ ভিন্ন গানে ভিন্নভাবে ধরা দিচ্ছে। প্রতিটি গানই বিভিন্ন ভাবের বাহন, গান হয়েও কবিতা আর ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির আকর। (খাতুন ১৯৯৪: ২৯)
তাই তাঁর সিদ্ধান্ত – রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী সাধারণের চিত্তে সাড়া জাগাতে পারছে না–বিস্ময়কর নয়। ‘রবীন্দ্রচিন্তা এবং ভাবকল্পনার সঙ্গে পরিচিত শিক্ষিত চিত্তের কাছে এই কাব্যগীতি যতখানি ভাব ও রসে পূর্ণ, সাধারণের কাছে তেমন হওয়া দুষ্কর।‘ (খাতুন ১৯৯৪: ২৯)
রবীন্দ্রনাথের কাব্যগীতি বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নাই । তবে ‘রবীন্দ্রচিন্তা এবং ভাবকল্পনার সঙ্গে পরিচিত শিক্ষিত চিত্ত‘ যে কি প্রকার ভাব ও রসপূর্ণ তার কিঞ্চিৎ আভাস সন্জীদা খাতুনের আলোচনায় পাওয়া যায়। তাঁর সরলতায় আমি মুগ্ধ। বাংলা জগতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই এই রকম ভাবেন। সরল সন্জীদা খাতুনের মতন দু-একজন মাত্র সাহস করে সেই ভাবনা লেখেন। তাই এতটা ঘটা করে আমরা তাঁর কহতব্য নকল করলাম ।
১
আমার ধারণা, ভদ্রশ্রেণীর লোকমহিলারা যাকে বাউল বা কীর্তন গান বলে নির্দেশ করেন ‘তার মর্মগ্রহণের জন্য নতুন চিন্তা বা বোধশক্তির প্রয়োজন নেই‘ – এই কথাটা একটু অতিরঞ্জিত। নিজের এন্তেকাল সংবাদ শুনে আমেরিকার বিখ্যাত গল্প লেখক মার্ক টোয়েনও – শোনা যায় – বলেছিলেন, ‘খবরটা একটু অতিরঞ্জিত‘। মহাত্মা লালন ফকিরের একটি পরিচিত গানের অংশবিশেষ বিচার করে আমি দেখাতে চাই – তার মর্মগ্রহণের জন্য একটু-আধটু নতুন চিন্তা বা বোধশক্তি সম্ভবত অপ্রয়োজনীয় নয়। মহাত্মার ‘এদেশে বহুদিন ধরে প্রচলিত‘ একটি গানের নজির দিয়ে শুরু করা যাক । লালন গেয়েছেন:
বাড়ির কাছে আরশি নগর
সেথায় এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে ॥
ফকির জিজ্ঞেস করেছেন – আরশি নগর কেমন শহর? আর এর নাগরিক পড়শিটাই বা কেমন জীব? গত শত-দুইশত বৎসরে এর সন্তোষজনক কোন জবাব কেউ কি দিয়েছেন? আমার প্রস্তাব জর্মান ভাষার মনীষী ফ্রয়েডের আবিষ্কারকে লালনের প্রশ্নের উত্তরজ্ঞানে দেখা যায়। লালন ফকিরের আরশি নগর ফ্রয়েড-কথিত ‘অচেতন’ বা অজ্ঞান নামক ধারণার অপর নাম। আর লালন অভিহিত ‘পড়শি’ ফ্রয়েড-পথিক জাক লাকাঁ প্রস্তাবিত ‘অপর’ বৈ নয়। লাকাঁ দুই অপরের কথা পেড়েছেন: বড় অপর ও ছোট অপর । লালনের পড়শি ‘বড় অপর’কেই নির্দেশ করে । চলতি বাংলায় একে ‘পরম‘ বলা হয়। এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার জন্য লাকাঁর হাদিস আলোচনা না করে গতি নাই ।
‘অচেতন’ কী বস্তু? ফ্রয়েড এই বস্তু আবিষ্কার করেছেন প্রায় একশ বছর আগে। সেই আবিষ্কারের তাৎপর্য অনেকদিন মানুষের অধরা ছিল । প্রায় পঞ্চাশ বৎসর আগে ফরাসিদেশের ডাক্তার জাক লাকাঁ আবার ফ্রয়েড-আবিষ্কার করেন। ফ্রয়েডের আবিষ্কারের অর্থ লাকাঁই নতুন করে ধরিয়ে দেন। লাকাঁর মতে, এই আবিষ্কার মনুষ্যজাতির চিন্তায় একটি বড় আকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। লাকাঁ শুরু করেছেন ফরাসি দার্শনিকদের রাজা দেকার্তের নামে । আমি কে? – এই প্রশ্নের উত্তরে দেকার্ত বলেছিলেন: ‘আমার ভাবনাতেই আমার পরিচয়।‘ এই যে আমি প্রশ্ন করি সে-ই তো আমি। আমি যে প্রশ্ন করি তার উপর আবার প্রশ্ন হয় কি? জর্মান দার্শনিকদের বাদশাহ্ হেগেল পর্যন্ত মূল উত্তরের একই ধারা। আমার চেতনাতেই আমি নিষ্পন্ন- মনের কাণ্ডকারখানা (Phenomendogy of Spirit) নামক কেতাবে হেগেলের প্রতিপাদ্যও তাই। লাকাঁ দেখিয়েছেন, ফ্রয়েডের আবিষ্কার অনুসারে এই পুরাতন প্রশ্নের সম্পূর্ণ নতুন জবাব মেলে। আমি কে? আমি আমি নই, অন্য কেউ। আরো কড়াকড়ি বলতে: আমি ও আমার অপর মিলে আমি একটা অন্য কিছু। আমার ভাবনাতেই কেবল আমার পরিচয় লুকিয়ে থাকে না–থাকে আমার নির্ভাবনায়, আমার অচেতনেও । লালনের বাক্যে বলতে, আমি ও আমার পড়শি মিলেই ‘আমি- নই‘ নামক নতুন ‘আমি’।
বিশদ করা যাক । একলা মানুষের কোন অচেতন নাই । শুদ্ধ পড়শির স্পর্শে আসার পরই অচেতন তৈরি হয়। সেই বিচারে মানুষ মানুষ হয়েছে নিজের প্রতাপে নয়— হয়েছে পড়শির গুণে । একইভাবে মানুষের মনুষ্যত্ব দাঁড়িয়েছে নিছক জীবনের আদরে নয়, মৃত্যুর ডাকেও । মানুষের পড়শি তার বাইরে নয়, ভিতরেও জুড়ে আছে । ফ্রয়েডের আবিষ্কারের এটাই তাৎপর্য। বড় কথা এই পড়শির সঙ্গে তার কখনো দেখা হয় না।
সে আর লালন এক সাথে রয়
তবু লক্ষ যোজন দূরে
কেন হয় না? লাকী বলেছেন: ‘মানুষের ভিতরের যেইটুকু তার নিজের হয়েও তার নিজের নয় সেই বস্তুকেই অচেতন বলে।‘ (লাকা ১৯৭৮: ১৯১) তো সে আর লালন এক সঙ্গে থাকে কোন সুবাদে? থাকে বাদের সুবাদে। ‘বাদ‘ মানে ‘বাত‘, মানে ‘কথা’র সুবাদে। মানুষের অচেতন সদা-সর্বদা বিরাজমান। কারণ, মানুষ বাতচিত করে। অচেতন বাতের ভিতরে এবং বাতের কাঁধে ভর দিয়ে চলাচল করে । কিন্তু মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয় না । কারণ কী? কারণ মানুষ কথা বলে, কিন্তু তার অর্থ বুঝতে সে সক্ষম নয় ।
কথার অর্থ গোপন থাকে দুই কারণে । পয়লা মানুষ ভাষা তৈরি করে না, শেখে । ভাষার অর্থ মানুষের অধরাই থাকে। দুই নম্বর কথা, দেকার্তের ‘আমি’ যেই পাহারা বসায় তা ভেদ করে কথা ভাষায় ঢুকতে পারে না । লাকাঁ বলেন:
এই উদাহরণ অনুসারে মানুষের ভাষার জগৎ এই স্থলে দুই টুকরা হয়ে যায়- এক টুকরা হাতের পাঁচ, চেনাশোনার ভিতর থাকে। আর টুকরা হাতের নাগালে থাকে না, থাকে অন্যখানে বাঁধা । (লাকা ১৯৭৫: ২২০)
ফ্রয়েডের আবিষ্কার অনুসারে মানুষের স্বাধীনতার বুলি ফাঁকা আওয়াজ মাত্র। মহাত্মা রুসো দাবি করেছিলেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায় আর সবখানে সে শিকলে আটকা পড়ে। লাকাঁর ব্যাখ্যা যদি ঠিক হয় তবে রুসোর দাবিও একটু অতিরঞ্জনের দোষে দুষ্ট। মানুষের জন্ম অসহায় অবস্থায় এবং মানুষ হওয়ার শর্তই – অর্থাৎ ভাষা ব্যবহার করাই এই বন্দিত্বের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ।
মানুষ ভাষা ব্যবহার করবে অথচ ভাষার আচার মানবে না – তা কী করে হয়? লাকা বারবার বলেছেন, অচেতনের গড়ন হুবহু ভাষার মতন। ভাষার উপর ভরসা করেই তো মানুষ কথা বলে। কিন্তু মানুষ যা বলে, ভাষা নিজে বলে তার শতগুণ । মানুষ বাবু, ভাষা পারিষদদল । চেতন যত বলে অচেতন বলে তার শতগুণ।
আমার ‘আমি’ যা বলে তা তো বলেই । কিন্তু ‘আমি‘ যা বলে না, তা-ই আরো বেশি বলে । অচেতনের ভাষা অবশ্য ‘আমি’র ভাষার হুবহু নকল নয়। সেই ভাষার নিয়মই আলাদা । সেই ভাষা ছড়ানো, সেই ভাষায় ‘না’ নাই এবং বড় কথা সেখানে আছে মৃত্যুর বাসনা । চেতন জগতের মতন সে মৃত্যু ভয়ে ভীত নয় । সব কথার শেষ কথা: ভাষাই মৃত্যু । অচেতন মৃত্যুর ভয়ে ভীত নয়, তাই ভাষার সত্য বা মৃত্যুময় নৃত্য অচেতনের দৌরাত্ম্যেই মানুষের ভিতরে ঢোকে । হুঁশিয়ার মানুষের নাগালে আসে না ভাষার এই মৃতরূপ (symbolic function)। লাকাঁর কথায়: ‘মানুষের সাথে তাঁর ভাষার এই অনাত্মীয়তাই অচেতনের আসল মর্ম। ফ্রয়েড অনবরত প্রমাণ করেছেন তাঁর চরিত অভিজ্ঞতার মূল সত্যও এটাই।‘ (লাকা ১৯৬৬: ৪৬৯)
ভাষার অনাত্মীয়-চরিত্র অনুসারে একলা মানুষের অচেতন গড়া। এই অচেতন – তাই বলা হয়। -বাইরে থেকে আসা। বাইরে থেকে আসা বলেই ভিতরে এসেও সে কিছুটা বাইরের থেকে যায়। এই বক্তব্য লাকাঁর জবানিতেই ভাল শোনায়:
অচেতন বস্তুটাকে আমি আপনাদের সামনে হাজির করছি মানুষের ভিতরের সেই পদার্থ হিসাবে যা শুদ্ধ মানুষের বাইরে এসেই নিজেকে আদায় করতে পারে। বাইরে এসে মানে সেই বড় পড়শির জায়গায় এসে । শুদ্ধ সেখানেই তার কায়দা-কানুন স্পষ্ট হয়। (লাকা ১৯৭৩: ১৩৪)
২
ফকির লালনের আরশি নগর–লাকার ভাষ্য মোতাবেক চিন্তা করি তো বলতে পারি—ফ্রয়েডের আবিষ্কৃত এই অচেতন জগৎ বৈ নয় । সেই নগরের অলিগলি ভাষার মতন। ভাষা বলতে শুদ্ধ কথা নয়, কথার অধিক যে মৃত্যুময়তা তা-ও বুঝলেই এ কথা যথেষ্ট হবে। মানুষের বড় পড়শি – অনেকটা ঈশ্বরের মতন এই পড়শি সাহেব- এখানেই বাসা কিনেছেন । এখানে শুদ্ধ এইটুকু পরিষ্কার করলেই চলবে যে অচেতনই অপর নয়—অপর বাস করেন অচেতনের চৌহদ্দিতে। কিন্তু খোদ অচেতনই কখনো অপরের জায়গায় দাঁড়ান। আরশি নগরের ভিতর পড়শি থাকেন। কিন্তু খোদ আরশি নগরও কখনো পড়শি হয়ে ওঠেন। আধার ও আধেয়ের এই রকম বিপর্যয় ভাষার জগতে অভূতপূর্ব ঘটনা নয়। এই অর্থে আরশি নগর ও বড় পড়শি একই বস্তু বটেন।
এক মানুষের সঙ্গে আর মানুষের সম্পর্ক – এক পড়শির সাথে আর পড়শির সাক্ষাৎ—এই বড় পড়শির বাড়ি বা তার আরশি নগরেই ঘটে। ভাষা বিনে উপায় নাই। এক মানুষের মনে কী আছে তা শুদ্ধ ভাষাই জানেন – তা আর মানুষ জানেন শুদ্ধ ভাষারই দয়ায়। চেতন সব সময়ই – এক্ষণে – অচেতনের দয়ার উপর নির্ভরশীল। অচেতন চলে কিসের জোরে? ফ্রয়েড বলেছেন: এই জোরের নামই ‘বাসনা’। প্রশ্ন উঠবে: বাসনা কোন গাছের গোটা? লাকাঁর উত্তর শোনার মতন: ‘অভাবের সাথে ভাবের সম্পর্কই বাসনা।‘ ইংরেজিতে অনুবাদ করলে আরো ভাল শোনায়: Desire is a relation of being to lack. লাকাঁ বলেন:
এই অভাব – সত্য বলতে – ভাবের অভাব। এটার বা সেটার অভাব নয়, বরং সেই ভাবের অভাব, যার উপর ভর করে ভাব দাঁড়ায়। (লাকা ১৯৭৮: ২৬১)
বাসনারই একটা রূপ ‘কামনা‘ বা ‘প্রকৃতি-রতি‘ বা সংক্ষেপে ‘রতি’ (sexuality)। ফ্রয়েডের আবিষ্কারের এই মুখটাই আজ পর্যন্ত ইতুরে ব্যাখ্যায় বিখ্যাত হয়ে আছে। এর তাৎপর্য আরো বড়। এর ভিতরে মহাত্মা লালন ফকিরের প্রশ্নের উত্তর নিহিত।
আরশি নগর কেমন শহর? নদীর ঐ পারেই শহরটা। কিন্তু কেমন জানি কুয়াশা কুয়াশা। নদী পার না হয়েও যেমন জ্যামিতিওয়ালা নদীর ওসার কত বার করতে পারেন – আরশি নগর না গিয়েও তেমনি তার মাপজোক নেওয়া যায়। মানুষের ভাষাই সেই নগরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানচিত্র। ভাষা বিহনে এই শহরও বিলকুল গায়েব, বিলক্ষণ লাপাত্তা ।
৩
ফ্রয়েডের আবিষ্কার মানুষের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে। স্বাধীনতার মতন মানুষের তথাকথিত ব্যক্তিত্বও এক বিশাল ঘোড়ার ডিম। ঘোড়ার ডিম দুনিয়ায় না থাক কী হয়েছে, ভাষায় তো আছে! ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও তাই। দেকার্ত থেকে হেগেল পর্যন্ত এয়ুরোপের প্রথম সারির ভাবুকরা যেই স্বপ্ন দেখেছেন তা আমিত্বের অহঙ্কারে ভরা । ফ্রয়েড তাতে একটা বড় আকারের ফুটো করে দিয়েছেন। ব্যক্তির কেন্দ্র আর ব্যক্তির ভিতর নাই – তার কেন্দ্র অন্যত্র। মানুষের নতুন সংজ্ঞা এখন এইভাবে দিতে হবে: ‘যেই বস্তু একই সাথে দুই জায়গায় বাস করে তাকেই মানুষ বলে।‘ এক জায়গার নাম আরশি নগর আর জায়গার ‘বাড়ি‘। অথবা ‘মানুষ তাকেই বলে যে একই সঙ্গে মানুষ ও মানুষের পড়শি।‘ অর্থাৎ একই সাথে মানুষ ও ঈশ্বরকে মানুষ বলার একটা রাস্তা তৈরি হল। যেই মানুষ সেই বস্তু জানে না সে কী করে জানবে সে কী বলছে? লাকার উক্তি: ‘মানুষ কী বলছে তা নিজেই জানে না – এবং জানে না খুব সঙ্গত কারণেই – কারণ সে কী তা-ই সে জানে না।‘ (লাকী ১৯৭৮: ২৮৬) জ্ঞানগাছের গোটা খেয়ে আদমজি বেহেশত হারিয়েছিলেন আর ফ্রয়েডের ফল খেয়ে এখন মানুষ চেতন-শহর বা বাড়ি থেকেও বিতাড়িত।
ফ্রয়েড যখন প্রথম এই প্রস্তাব পেশ করেন তখন তাঁকে নতুন ধরনের রাহসিকতা ঠাওরানো কঠিন ছিল না । জাক লাকাঁর ব্যাখ্যার পর এতদিনে সেই কথা স্পষ্ট হয়েছে (বা অন্তত তা হওয়া সম্ভব) যে অচেতনের জগৎ অলৌকিক জগৎ নহে। আরশি নগর লোকালয়ের তপশিলভুক্ত। এই নগর ভাষার নগর। উচ্চারণের আগেও পর, পরেও পর – শুদ্ধ উচ্চারণের মুহূর্তেই ভাষা মানুষের শহর ।
মানুষ কী করে মানুষ হল? এই প্রশ্নের উত্তরে জাঁ জাক রুসো প্রমুখ মহাত্মা সমাজগড়ার চুক্তি কল্পনা করেছিলেন। আসলে এই চুক্তি ভাষাচুক্তি ছাড়া আর কী? ফ্রয়েডের আবিষ্কারের সাক্ষাৎ ফল মানুষের অন্তর্গঠনে ভাষার ভূমিকা নতুন কায়দায় বোঝার পথ খুলে যাওয়া। মানুষ বলতে যদি আমরা আজ পর্যন্ত রক্তমাংসে গড়া কোন জীবের অভিজ্ঞতা বা বংশগতি বুঝে থাকি তা নিতান্তই অল্প বোঝা। লাকী পরিষ্কার মনে করেন, যাকে আমরা মানুষ বলি তা কোনক্রমেই ব্যক্তিমানুষ মাত্র নয়। ফ্রয়েড আমাদের এই সত্য নতুন পথে—পুরানো দার্শনিক-অর্থে বস্তুবাদী কায়দায় – শিখিয়েছেন ।
মার্কস একদা স্বপ্ন দেখেছিলেন হেগেলকে আবার তাঁর পায়ের উপর দাঁড় করাবেন। কারণ মহান তত্ত্বজ্ঞানী সত্যকেও উল্টা মাথার উপর খাড়া করে রেখেছিলেন । কিন্তু খোদ মার্কসই বুঝতে পারেন নাই: হেগেলের দর্শনের গোড়া না কেটে এই অসম্ভব-কর্ম সম্ভব ছিল না। মানুষের সামাজিক সম্পর্কই তার ভাবনাকে নিষ্পন্ন করে – মার্কস এইটুকু পর্যন্ত গিয়েছেন। আর ফ্রয়েড দেখিয়েছেন মানুষেরই সামাজিক সম্পর্ক কিভাবে খোদ মানুষের চাষ করে । ফ্রয়েডের আবিষ্কার এই বিচারে সাক্ষাৎ মানুষ আবিষ্কারের সমান ।
ভাবতে ভাল লাগছে: মহাত্মা লালন ফকির নিজের ভাষায় এই আবিষ্কারই সম্পন্ন করেছিলেন। পরাধীনতা আমাদের যত ক্ষতি করেছে তার মধ্যে এই বোধশক্তি হারানোটাই সম্ভবত প্ৰধান ।
দোহাই
- সন্জীদা খাতুন, তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৪)।
- Jacques Lacan, Le Seminaire de Jacques Lacan, Livre II: Le moi dans la theorie de Freud et dans la technique de l’analyse (Paris: Editions du Seuil, 1978).
- ………….., Le Seminaire de Jacques Lacan, Livre I: Les Écrits techniques de Freud (Paris: Editions du Seuil, 1975).
- ………….., Le Seminaire de Jacques Lacan, Live XI: Les Quartes Concepts Fondamentaux de la Psychanalyse (Paris: Editions du Seuil, 1973).
- …………..,Écrits (Paris: Editions du Seuil, 1966).
উৎস; অচেতন ৷৷ ঢাকা ২০০১